Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ৪৬

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৪৬

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৪৬
গোপাল জীউ মন্দির, কাজলাগড় (ভগবানপুর থানা)
চিন্ময় দাশ

শ’ চারেক বছর আগের কথা। ওডিশার ময়ূরভঞ্জের পাহাড়ি এলাকা থেকে এক ব্যক্তি বাংলার সীমান্ত জেলা মেদিনীপুরে চলে আসেন। নাম– গোবর্ধন রণঝাঁপ। জাতিতে ব্যাধ। লোকশ্রুতি হল, একবার দেবী কালিকার স্বপ্নাদেশ এবং একটি কালীমূর্তি পেয়ে, একটি মন্দির গড়েছিলেন গোবর্ধন। ক্রমে গড়খাই কেটে বস্তু ঘিরেছিলেন। নাম করেন– কালীর গড়। সেই নামই পরে কাজলাগড় হয়েছিল।
শাহজাহানের রাজত্বকালে ২৮টি পরগনা নিয়ে হিজলী ফৌজদারী গঠিত হয়েছিল। সেসময় হিজলীর জমিদার ছিলেন তাজ খাঁ মসনদ-ই-আলা। সেই বংশের পতনের পর, জমিদারীটি ৩ ভাগে ভাগ হয়ে যায়– জলামুঠা, মাজনামুঠা এবং সুজামুঠা। গোবর্ধন রণঝাঁপ সুজামুঠায় জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্ব তখন, ইং ১৫৮৪ সাল নাগাদ।


গোবধনের হাতে যে বংশের প্রতিষ্ঠা, আড়াই শ’ বছর পরে, ১৮৩৭ সালে রাজা গোলকেন্দ্র নারায়নের হাতে তার বিলোপ। এর মাঝখানে আরও ১০ জন জমিদার হয়েছেন সুজামুঠা জমিদারিতে। তাঁরা হলেন– মাধবচন্দ্র, শ্রীধর নারায়ণ, গোপাল নারায়ণ, গোরাচাঁদ, নরেন্দ্র নারায়ণ। তিন নাবালক পুত্র রেখে, নরেন্দ্র মারা যান. তখন তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজেন্দ্র নারায়ণ সাবালক না হওয়া পর্যন্ত, নরেন্দ্রর পত্নী সুদক্ষ হাতে জমিদারি পরিচালনা করেছেন। তিনিই কাজলাগড়কে সুজামুঠা জমিদারীর রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন।


রাজেন্দ্রর পর গজেন্দ্র নারায়ণ, মহেন্দ্র নারায়ণ, দেবেন্দ্র নারায়ণ, গোপালেন্দ্র নারায়ণ রাজা হন। ৩০ বছর রাজত্ব করে, অপুত্রক গোপালেন্দ্র মারা গেলে, তাঁর পত্নী সুলোচনা দেবী, দেবর-পুত্র গোলকেন্দ্র নারায়ণকে দত্তক নিয়ে রাজাসনে বসিয়েছিলেন। সময় ছিল ১৮৩৭ সাল।
১৮৩৭ থেকেই কাজলাগড় জমিদারীর পতনের সূচনা। শিক্ষিত ও তীক্ষ্ন বুদ্ধিধারী হলেও, গোলকেন্দ্রর বিলাসিতা, উপপত্নী, মোসায়েবদের নিয়ে মাদক সেবন ইত্যাদিতে ঋণের জালে জড়াতে থাকেন তিনি। হবে না-ই বা কেন? সিগারেট ধরাতেন টাকার নোট পুড়িয়ে। ঘুড়ি ওড়াতেন একশো টাকার নোট গেঁথে গেঁথে। পরে সেগুলো ইয়ার-বন্ধুদের বিলিয়ে দিতেন।

ফলও ফলেছিল হাতে হাতে। রাজস্ব বকেয়ায় জমিদারী নিলামে যায়। বর্ধমানের রানি নারায়ণকুমারী দেবী পুরো জমিদারি কিনে নেন। তবে, দয়াপরবশ হয়ে, হতভাগ্য রাজা এবং রানীকে মাসিক বৃত্তি দিতেন তিনি।
তবে, সুদক্ষ পরিচালনার জন্য একদিন ‘চৌধুরী’ এবং ‘রায়’ খেতাব পেয়েছিল এই বংশ। উল্লেখ করবার মত রাজাও ছিলেন কয়েকজন। ১. বিশাল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ, মন্দির, রাসমঞ্চ দিয়ে তাকে সাজিয়ে তুলেছিলেন মহেন্দ্র নারায়ণ। ২. তাঁর পুত্র দেবেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন বিদ্বান, গুনগ্রাহী, দানশীল। সদ ব্রাহ্মণ ও সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের নিজের জমিদারিতে ভূমিদান করেছেন। ভাটপাড়ার বিখ্যাত পন্ডিত মহামহোপাধ্যায় পঞ্চানন তর্করত্নের পিতামহ প্রসিদ্ধ পন্ডিত রামকানাই বাচস্পতি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ৩. ১৮০১ সালে গভর্ণর জেনারেল ওয়েলেসলি জেলার সম্ভ্রান্ত ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের নামের তালিকা চাইলে, জেলা প্রশাসন যে উত্তর পাঠায়, তাতে ১৪ ক্রমিকে এই বংশের গোপালেন্দ্র নারায়ণের নাম ছিল। এসবই হল সুজামুঠা রাজবংশের রামায়ণ।’


তবে, একটি সংযোজন আছে পরিশিষ্ট হিসাবে। পুরো পরগণা বর্ধমানের অধিকারে গেলে, জমিজমার জরীপ এবং জমাবন্দীর কাজে একজন সেটেলমেন্ট অফিসারকে পাঠানো হয়েছিল। কাজলাগড়ের একটি বাংলোবাড়িতে ৩ বছর অবস্থান করেছেন তিনি। একদিন সকালে কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর, অফিসার-পত্নী সামনের বকুলগাছের তলায় বসে একটি মালা গেঁথেছিলেন। দিনান্তে কর্মক্লান্ত স্বামী ফিরে এলে, স্বামীর গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন মালাটি। আবেগে আপ্লুত রাজকর্মচারীর কলম নিয়ে বসলেন। রচনা করলেন সেই বিখ্যাত সংগীতটি — ”আমি সারাটি সকাল বসে বসে এই সাধের মালাটি গেঁথেছি। ..”। এখন বোধকরি বলে দেওয়ার প্রয়োজন নাই, অফিসার ছিলেন– কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্র লাল রায়।
ডি. এল. রায়ের কাজলাগড়ে অবস্থানকে স্মরণীয় করে রেখেছেন স্থানীয় সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষজন। কাজলাদীঘির পাড়ে একটি স্মৃতিমন্দির গড়ে প্রণতি জানানো হয়েছে কবিকে।

এসব থাক। আমরা এবার মন্দিরটির বিষয়ে ফিরে যাই। আমাদের আলোচ্য মন্দিরটি ছিল আকারে বিশাল, বর্গাকার। দৈর্ঘ্য প্রস্থ সাড়ে ৩৫ ফুট, উচ্চতা প্রায় ৫৫ ফুট. নবরত্ন রীতির ইটের তৈরি। নির্মিত হয়েছিল মহেন্দ্র নারায়নের হাতে, কুলদেবতা গোপাল জিউর জন্য। কিন্তু মন্দির নয়, আজ যা আছে, সেটি একটি ধ্বংসস্তূপ মাত্র। মন্দিরের টুকরো-টাকরা কঙ্কালই দেখা যায় কেবল।
নবরত্ন রীতির ইটের তৈরি সৌধ। একেবারে রাজকীয় গড়ন। উত্তর ছাড়া, বাকি তিন দিকে প্রশস্ত অলিন্দ। তাতে ইমারতি রীতির স্তম্ভ এবং দরুণ রীতির খিলানে তিনটি করে দ্বারপথ।
এখানে অলিন্দের পরেই গর্ভগৃহ নয়। তিন দিকেই তিনটি করে কুঠুরি গড়া হয়েছিল। মাঝের কুঠুরি দিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ, তিন দিক থেকেই।

দ্বিতলের গর্ভগৃহটিও বেশ বড় ছিল, অনুমান করা যায়। ত্রিতলের কথা বলা যায় না। বলা যায় না রত্নগুলিরকথাও। সেগুলিতে রথ-ভাগ কিংবা পীঢ়-রীতি প্রয়োগ হয়েছিল কিনা, আজ আর জানবার পথ নাই। তবে ভগ্নস্তুপ থেকে নিচতলার কক্ষগুলির সিলিংয়ের কারিগরী বুঝে নেওয়া যায়। গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছিল ধাপে ধাপে ভল্ট নির্মাণ করে। অলিন্দগুলিতে সিলিং ছিল টানা-খিলানের। আর ছোট ন’টি কক্ষে ছিল চারটি করে পাশ খিলানের সিলিং।
মন্দিরের সামনের অংশে দু’দিকে থামওয়ালা প্রলম্বিত দেওয়াল থেকে অনুমান করা যায়, বড় মাপের একটি নাটমন্দিরও ছিল এখানে।
যাওয়া-আসা : কলকাতা-মেচেদা-দিঘা বাসরুটের বাজকুল। কিংবা হাওড়া-দিঘা রেলপথের দেশপ্রাণ স্টেশন। সেখান থেকে ২ কিমি পশ্চিমে কাজলাগড়। পথের অদূরেই রাজবাড়ি আর মন্দিরের খন্ডহর, কাজলদীঘি আর কবির স্মৃতিবেদী।

 প্রচ্ছদ ঃ  রামকৃষ্ণ দাস 

RELATED ARTICLES

Most Popular