জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল—৪৩
চন্ডী মন্দির, খরিদা (খড়গপুর শহর)
চিন্ময় দাশ
খুব বড় শহরের খুব ছোট একটি মহল্লা। নাম তার খরিদা। আর বড় শহরটি হোল খড়গপুর। ভারতের একটি বড় রেলওয়ে শহর।
খরিদা শব্দটি আদিতে ছিল খুর্দা বা খোর্দা। একটি ফারসী শব্দ। যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়– ছোট। আকার বা আয়তনে ছোট এলাকা, তাই নাম হয়েছিল খুর্দা। কালে কালে লোকমুখে সেই নামই খরিদা হয়ে উঠেছে।
তাহলে, এই অবসরে খড়গপুর শহরের নামটিও কীভাবে গড়ে উঠেছিল, দেখে নেওয়া যাক। এই শহরের ইন্দা মহল্লায় রয়েছে বিখ্যাত খড়্গেশ্বর শিব মন্দির। সেই শিবের নাম থেকেই খড়্গপুর নামের উৎপত্তি। কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মন্দিরটি ? ১. কেউ বলেন, বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবংশের খড়্গ মল্ল মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই শিবের খড়্গেশ্বর নাম। একটি ভিন্ন মতও আছে। ২. অন্য মতটি হল, হুগলির দশঘরা থেকে এসে জনৈক নারায়ণ চন্দ্র পাল জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, নবাবী সনন্দ নিয়ে। তাঁর পৌত্র খড়্গ সিংহ পাল নিজের নামে খড়্গেশ্বর মন্দির স্থাপন করেছিলেন।
এহেন খড়গপুর শহরের খরিদা মহল্লায় বহুকালের একটি ভগ্ন মন্দির দেখা যায়। তারাপদ সাঁতরা, প্রণব রায়, ড. গঙ্গাধর সাঁতরা প্রমুখ যাঁরাই মেদিনীপুর জেলার মন্দির নিয়ে কাজ করে গিয়েছেন, অনেক অর্বাচীন মন্দিরের নাম থাকলেও, তাঁদের কারও বিবরণেই এই মন্দিরের উল্লেখ নাই। এর কারণ অনুধাবন বেশ কঠিন।
মাকড়া পাথরের মন্দির। মুড়ে দেওয়া হয়েছিল চিকন পঙ্খের আস্তরণ দিয়ে। কিন্তু কোন দেবতার মন্দির ছিল এটি, তা আজ আর জানা যায় না। মন্দিরের গর্ভগৃহে অধিষ্ঠিত থেকে যিনি ভক্তদের অর্ঘ গ্রহণ করতেন, পূজক ব্রাহ্মণ যাঁকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্রোচ্চারণ করতেন সকাল সন্ধ্যায়– তিনি কে? তিনি দেবতা, না দেবী? কে উত্তর দেবে? কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে সেই নাম। কে তুলে আনবে !
এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। ১. আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে যাঁরা সমীক্ষা বা নিবন্ধ রচনা করেন, তাঁরা কেউ কেউ বলেন, এটি গঙ্গা মন্দির। এই মন্দির থেকে উত্তরে অদূরে কংসাবতী নদী। সমগ্র এলাকা ছিল ঘণ জঙ্গলে ঢাকা। বসবাস ছিল ছিল কেবল ধীবর সম্প্রদায়ের। তাঁদেরই আরাধ্যা দেবী গঙ্গার মন্দির হিসাবে এটি নির্মিত হয়েছিল।
২. স্থানীয় অধিবাসীগণ (মানিক চন্দ্র মাইতি- পাড়ামুখ্য , গৌরচন্দ্র ঘোষ- জরিপ বিভাগের কর্মী, শিবপ্রসাদ ঘোষ- ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহকুমা আধিকারিক প্রমুখ), যাঁদের আহ্বানে গিয়েছিলাম ভাঙ্গা মন্দিরটি সমীক্ষায়, তাঁরা বলেন, এটি চণ্ডীদেবীর মন্দির। বস্তুত, লোকসমাজে চন্ডীই হলেন বহুজন পূজিতা। গ্রামে গ্রামে তাঁর মন্দির বা থান দেখা যায়।
৩. উৎসাহী এমন গবেষকও আছেন, যিনি এটিকে চন্ডীমন্দির মান্য করেই লিখেছেন, কোনও খয়রা রাজার হাতে নির্মিত এই মন্দিরটিকে মকর-চন্ডী মন্দির বলা যেতে পারে। তিনি আরও বলেছেন, ১৫৬৭ – ৬৮ সালে এই মন্দির থেকে সামান্য দূরের চাঙ্গুয়াল গ্রামের খয়রা রাজার নির্মিত কালনাগিনী মন্দিরটি কালাপাহাড়ের হাতে ধ্বংস হয়ে গেলেও, ঘণ জঙ্গলে ঢাকা এই মন্দিরটি কালাপাহাড়ের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল।
এই নিবন্ধে বিশদ আলোচনার অবকাশ নাই। কোনও যুক্তি, তর্ক বা বিশ্লেষণেরও অবতারণা করব না আমরা এখানে। শুধু রেল শহর হিসাবে গড়ে উঠবারও বহুকাল আগের একটি প্রাচীন মন্দির ছিল খরিদা এলাকায়, এই কথাটুকু এবং মন্দিরটির গঠনশৈলী কেমন ছিল, সেটির বিবরণই রেখে যেতে চাই আমরা।
আমরা এই মন্দিরকে চন্ডী মন্দির হিসাবে বিবেচনা করি। মন্দিরটি পূর্বমুখী। সম্পূর্ণ বর্গাকারে গড়া হয়েছিল এটিকে– দৈর্ঘ্য-প্রস্থ দুই-ই সাড়ে ১৬ ফুট। উচ্চতা আনুমানিক ২৫ ফুট। পাদপীঠ বা ভিত্তিবেদীটি বেশ উঁচু। যদিও ভারী জীর্ণ দশা সেটির, এখনও আড়াই ফুট উচ্চতা বজায় আছে। মাকড়া (ল্যাটেরাইট) পাথরের উপাদানে গড়া।
চালা-শৈলীতে গড়া হয়েছিল, সেটি স্পষ্ট অনুধাবন করা যায়। কিন্তু ছাউনি অংশটি এতটাই ভাঙ্গা-চোরা যে, চার-চালা না কি আট-চালা, কোন রীতির– তা আর অনুমান করবার উপায় নাই।
দুটি অংশ এই সৌধের– সামনে অলিন্দ, পিছনে গর্ভগৃহ। অলিন্দে প্রবেশের জন্য খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ। মাঝখানে দুটি পূর্ণ-স্তম্ভ (পিলার), এবং দুই প্রান্তে দুটি অর্ধ-স্তম্ভ (পিলাস্টার)-এর সাহায্যে দ্বারগুলি রচিত হয়েছে। স্তম্ভগুলি ইমারতি রীতির, এবং খিলানগুলি দরুণ রীতিতে নির্মিত। গর্ভগৃহের পরিসর বেশ সংকীর্ণ। তাতে দুটি দ্বারপথ। সামনেরটি ছাড়াও, উত্তর দিকে অতিরিক্ত একটি দ্বারপথ আছে। প্রধানত পুরোহিত ঠাকুরের জন্যই এই অতিরিক্ত দ্বারটি রচিত হয়ে থাকে। বহু মন্দিরেই এটি দেখা যায়। এখানে উল্লেখ করা দরকার, অলিন্দ থেকে গর্ভগৃহটি কিছু নীচু।
অলংকরণ বলতে আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নাই মন্দিরে। দেওয়াল থেকে পঙ্খের পলেস্তারাও প্রায় সবই মুছে গিয়েছে। ফলে, কোনও অলংকরণের কাজ ছিল কিনা, বোঝার তেমন উপায় নাই। এখন একটি মকর-মূর্তি কেবল টিকে আছে, দেখা যায়। এটি দেখেই কেউ কেউ এটিকে গঙ্গা দেবীর মন্দির– এমন অনুমান করে থাকেন।
যাওয়া-আসা : খড়্গপুর শহরের গিরি ময়দান স্টেশন বা বড়বাতি এলাকায় এসে, খরিদা রেলগেট। সেখান থেকে পূর্বমুখে সামান্য পথ এগোলে, পাড়ার ভিতরে ভাঙ্গা মন্দিরটি খুঁজে পাওয়া যাবে। স্থানীয় মানুষজনই বলে দিতে পারবেন।
তথ্য সহযোগিতা : শ্রী সুগত পাইন, গবেষক ও প্রাবন্ধিক– দাসপুর।
প্রচ্ছদ-রামকৃষ্ণ দাস