চরণ ছুঁয়ে যাই – ২ অনিন্দিতা মাইতি নন্দীকবি নজরুলের ভিন্ন সত্ত্বা, বহুমুখী প্রতিভা আমার অন্তরাত্মায় আজও দোলা দেয় সেই কিশোরী বেলার মতো। একটি গান খুবই মনে পড়ে সেখানে উর্দু ও ফারসি মিশ্রিত বাংলা বিখ্যাত গান,
“আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন
দিল ওহি মেরা ফস গরি ।
** ** ** ** ** **
দেহের দেউড়িতে বেড়াতে আসিয়া
আউর নেহি উয়ো ওয়াপস গয়ি।।”
আসলে নজরুলের পিতৃব্য কাজী বজলে করীম ফার্সীতে বিশেষ পারদর্শী, কবিতাও চর্চা করতেন। তাঁর প্রভাবেই বিদ্রোহী কবি ছোটবেলা থেকেই উর্দু-ফারসি মিশ্রিত পদ্য বাংলায় লিখতেন এমনিই একটি কবিতা আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়,
“মেরা দিল বেতাব কিয়া তেরি আব্রুয়ে – কামান:
জ্বালা যাতা হ্যেয় ইশক মে জান পেরেশান|”
আমার সমস্ত মন জুড়ে ‘নজরুল গীতি ওই সঙ্গীত বইটি বার বার ঘুরে ফিরে গানগুলি পড়ি, আবার কখনো কখনো একমনে পড়ে যাই সঞ্চিতা, অগ্নিবীণার অনবদ্য কবিতাগুলি| তখন অদ্ভুত এক সাদৃশ্য বিশ্বকবি ও বিদ্রোহী কবির মধ্যে খুঁজে পাই আমি| কবি নজরুল যেন তাঁর অন্তরে দেবতার আসনে পূজা করেন বিশ্বকবি রবি ঠাকুরকে| অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি রবীন্দ্রনাথের নব আবিস্কৃত “মুক্তক-স্বরবৃত্ত” ছন্দকে বিদ্রোহী কবি শ্রদ্ধাভরে নিজের মত করে প্রয়োগ করেন ‘কামাল পাশা’ কবিতাটিতে| আবার গুরুদেবের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘সমিল মুক্তক মাত্রাবৃত্ত’ ছন্দে রচনা করলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা বিদ্রোহী, বাংলা ভাষায় কবি নজরুলই হলেন ‘সামিল মুস্তক মাত্রাবৃত্ত’ ছন্দের প্রবর্তক| বিশ্বকবিকে তো আমরা সকলেই শ্রদ্ধা করি, কিন্তু নজরুলের মত শ্রদ্ধা মিশ্রিত অনুসরণ বোধ হয় সেভাবে আর কেউ করেন নি| রবি ঠাকুরের গানের যে আকুতি রাগরূপের বিস্তার, কথার যে গভীরতা তা অন্তরের অন্তঃস্থলে এক প্রশান্তি এনে দেয় – নজরুলের গানের আবেদন ক্ল্যাসিক্যাল মিশ্রিত সহজেই চিত্ত জয় করে নেয়|
আমি বিদ্রোহী কবির বিশ্বকবিকে শ্রদ্ধাবনত অনুসরণের প্রয়োগে চমৎকৃত হই বারবার,
যখন রবি ঠাকুর লেখেন ‘১৪০০ সাল’-
“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহল ভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে|
সেখানে কবি নজরুল তাঁর সকল শ্রদ্ধা ও ভক্তি দিয়ে লেখেন
“আজি হ’তে শতবর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে|
শত অনুরাগে,
আজি হ’তে শতবর্ষ আগে|”
আবার রবি ঠাকুর ‘দুই বিঘা জমি’ তে লেখেন,
“নমঃ নমঃ নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি|
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জোড়ালে তুমি|”
সেখানে ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় বিদ্রোহী কবি লেখেন-
“নমো নমো নমো বাংলাদেশ মম
চিরমনোরম চির মধুর|”
আসলে আমি তো ভুলেই গেছিলাম যেখানে বিশ্বকবির কথামালা ‘সঞ্চয়িতা’ সেখানে তো বিদ্রোহী কবির কথামৃত ‘সঞ্চিতা’| রোমাঞ্চিত হই ক্ষণে ক্ষণে, বারবার ছুটে যাই বাবার লাইব্রেরীতে ‘নজরুল রচনা সম্ভার’ –এর সন্ধানে|‘গীতবিতান’ ও ‘নজরুলগীতি’ – চিন্তাধারায় দুই কবির এত সাদৃশ্য| গুরুদেবকে এভাবে আত্মীকরণ, এত প্রগাঢ় অনুসরণ, অনুকরণ!!!
এ আমি কোন বিদ্রোহী কবিকে দেখছি! –যার বিদ্রোহ সত্ত্বার পরতে পরতে এত প্রেম, এত বিরহ যন্ত্রনা- গুরুদেবের, ব্যথার প্রকাশ-
“আমার ব্যাথা যখন বাজায় আমায়
বাজি সুরে,
সেই গানের টানে পারো না আর
রইতে দূরে|”
আবার প্রেমিক নজরুলের ব্যথার প্রকাশ-
“গানগুলি মোর আহত পাখির সম
লুটাইয়া পড়ে তব পায়ে প্রিয়তম|”
প্রেমিক নজরুলের বিরহ বড্ড প্রিয় তাই মিলনের চেয়ে বিরহ যন্ত্রনার অনুভুতি তাঁকে বেশী আনন্দ দেয়,
“মালা যখন গাঁথ তখন-
পাওয়ার সাধ যে জাগে
মোর বিরহে কাঁদো যখন
আরও ভাল লাগে|”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের পরশ
“আমি তারে শুধাই যবে কী তোমারে দিব আমি
সে শুধু কয় আর কিছু নয় তোমার গলার মালাখানি|”
যতই আমি নজরুল সমুদ্রে ডুবছি অবাক শিহরণ আন্দোলিত হয়ে আমি যেন এক বিদ্রোহী সত্বার বহুমুখী সংমিশ্রণ সুরঝঙ্কারে, রাগ- রাগিণীর সুনিপুন মিশ্রণের অনায়াস প্রয়াসে, আত্মস্থ মগ্নচেতনার এক অপরূপ সত্বাকে অনুভব করছি|
এই নজরুল কি সেই কবি?- যিনি অবলীলায় বলতে পারেন
“আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
কিংবা,
“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেব পদচিহ্ন|
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!”
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে যিনি এমন আগুন ঝরানো উদ্দাম যৌবনের বার্তা বহন করেন তিনি কিভাবে লেখেন,
“মন জপ নাম শ্রী রঘুপতি নাম|”
কিংবা,
“সখি সে হরি কেমন বল
নাম শুনে যার এত প্রেম জাগে,
চোখে আনে এত জল!”
আমার সমস্ত মন জুড়ে ‘নজরুল গীতি’ –র সঙ্গীত বইটি, বারবার গানগুলি পড়তে পড়তে একজয়গায় থমকে যাই, – এমনিই একটি গানের কলিতে, যেখানে কবির বড্ড আদরের সন্তান বুলবুল অকালে ঝরে পড়লে, এই অনুভূতির প্রকাশ,
“শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়
ফিরে আয় ফিরে আয়|”
কী অদ্ভুত আকুতি কবির সন্তানকে ফিরে পাবার আশায় বর্ণনার প্রতিটি ছত্রে স্তম্বিত হয়ে যাই- এমনভাবেও লেখা যায়? পুত্রশোকেও কবির অকুলতা মর্মভেদ করে যায়-
“তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ,
পাণ্ডুর হল আকাশের চাঁদ|”
কিংবা
“তুই ফিরে এলে ওরে চঞ্চল
আবার ফুটিবে বনফুলদল|”
পুত্রশোকের আঘাত কবিকে আস্তে আস্তে অপ্রকৃতস্থ অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়| আর এখানেই নজরুল আর পাঁচজন পিতার ন্যায় একই অনুভুতি সম্পন্ন| রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন প্রিয়তম পুত্রের (শমী) অকাল প্রয়াণকে উপেক্ষা করেও প্রকৃতির কোলে ফিরে যেতে- অনুভব করেছিলেন প্রকৃতির একই রূপরস, তাই পুত্রের প্রয়ানের পর লিখেছিলেন ,
“আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে|”
আর এখানেই নজরুলের অভিন্ন হৃদয় পিতৃসত্বা আমাকে ছুঁয়ে যায় – হৃদয়ে মোচড় দেয়,
কবি নজরুল তাঁর সাহিত্য জীবনের শেষাংশে সঙ্গীত জীবনে ধ্যান মগ্ন হয়েছিলেন| অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় আগে পর্যন্ত তিনি সারাক্ষণ সঙ্গীত সাধনায়, সঙ্গীত রচনায় ব্যাপৃত ছিলেন| তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শ্রেষ্ঠ ও অন্যতম ফসল এই সঙ্গীতগুলি| তাঁর সংগীতগুলি মূলত কাব্যগীতি, রাগপ্রধান, গজল ইসলামী, ভক্তিগীতি, লোকগীতি, দেশাত্ববোধক, হাসির গান, ঝুমুর, ভাটিয়ালী, পল্লীসঙ্গীত, প্রেম ও প্রকৃতি নির্ভর গান| এই গানগুলির সুরবৈচিত্র এমন যে যেকোন গায়কীতেই এই গানগুলির মাধুর্য অনন্য|
মানুষ চেনার এক অনন্য ক্ষমতা ছিল বিশ্বকবির , তাই নজরুল সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধুমকেতু’ –র আশীর্বাদ বাণীতে বিশ্বকবি লেখেন,-
“কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েসু
আয় চলে আয়, রে ধুমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন|
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন|”
‘ধুমকেতু’ –আসলে ধুমকেতুই তার আবির্ভাব অপ্রত্যাশিত, স্বল্পায়ু সে, তবু তার ইতিহাস অবিস্মরণীয়| বিশ্বকবি তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন| তাঁর মতে “জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল” গুরুদেবের মতানুযায়ী, ‘নজরুলের কাব্যে অসির ঝনঝনানি আছে| আমি যদি তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ওই একই ঝংকার বাজতো|”
কবিকে আমার মত করে জানার প্রচেষ্টায়, কবির রচনা সম্ভারে তাঁর লেখা বিভিন্ন চিঠি পত্র পড়তে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়াই, শিহরিত হই- একটি অসামান্য চিঠি কবি লিখেছেন তাঁর প্রথম স্ত্রীকে| প্রথম স্ত্রীর থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর, বিচ্ছেদ ঘটলেও প্রথম স্ত্রীকে তিনি বিস্মৃত হতে পারেন নি| বিচ্ছেদের ষোল বছর পর প্রথম স্ত্রীর প্রত্যুত্তরে কলম ধরলেন, যার একদম শেষ অংশটুকু গায়ে কাঁটা দেয়-
“তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক| যেখানেই থাকি, বিশ্বাস করো, আমার অক্ষয় আশীর্বাদী কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে| তুমি সুখী হও, শান্তি পাও- এই প্রার্থনা| আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই – এই আমার শেষ কৈফিয়ত|”
কবির প্রথম স্ত্রী তাঁর রচিত কোন এক পুস্তকে নজরুল সম্মন্ধে বক্রোক্তি করেছিলেন, কবি তাঁর প্রথম পত্নীর চিঠির প্রত্যুত্তরে দীর্ঘ চিঠি লেখেন ও শেষে বলেন, “আমার- ‘চক্রবাক’ কবিতা পুস্তকে তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে|”
আমি ‘চক্রবাক’ –এর ‘হিংসাতুর’ কবিতার কয়েকটি লাইন পড়েই হতবাক হলাম, কবি আঘাত করলে, ফুল দিয়ে আঘাত করেন, অসুন্দর- কুৎসিতের সাধক নন তিনি|
“হিংসাই শুধু দেখেছ এ চোখে? দেখ নাই আর কিছু?
সম্মুখে শুধু রহিলে তাকায়ে, চেয়ে দেখিলেনা পিছু?
** ** ** ** ** **
সেই ভালো তুমি চিরসুখী হও, একা সেই অপরাধী|”
তোমাকে জানা চেনা আমার ফুরবেনা কবি- সেই ছোট্ট মেয়েটি যে দীঘল অতলস্পর্শী চোখের আকর্ষণে বারবার তোমার ছবির দিকে অকর্ষিত হত, সে আজও তোমার লেখার অনুরাগী, তোমার গীতি কথা ছন্দে দোলায়িত, আজও আমি সুরের ও বাণীর মালা দিয়ে তোমার ‘চরণ ছুঁয়ে যাই’|
*********