জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৬৬
রামেশ্বর শিব মন্দির, রাজবল্লভ (পিংলা, মেদিনীপুর জেলা)
চিন্ময় দাশ
” দানে চনু, অন্নে মনু, রঙ্গে রাজনারায়ণ। / কীর্ত্তে ছকু, বিত্তে নরু, রাজা যাদবরাম।। ” এককালে মেদিনীপুর জেলা জুড়ে প্রচারিত ছিল প্রবাদটি। মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত। প্ৰবাদবাক্যটি তৈরী হয়েছিল ৬ জন জমিদারকে নিয়ে। নিজের নিজের কীর্তি আর গুণে খ্যাত হয়েছিলেন এঁরা। মেদিনীপুরের মুখ উজ্বল করেছিলেন।
আমাদের আজকের প্রতিবেদনের নায়ক হলেন এই প্রবাদবাক্যের প্রথম বক্তি– চনু বা চন্দ্রশেখর ঘোষ। দানবীর হিসাবে খ্যাত হয়েছিলেন মানুষটি। চন্দ্রশেখরের প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে, বাকি ৫ জনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে রাখছি আমরা। পাঠক-পাঠিকার তৃপ্তি হতে পারে তাতে, এই ভাবনায়।
১. মানু– মানগোবিন্দ ভঞ্জ , অন্নদানের জন্য খ্যাত ডেবরা থানার পুঁয়াপাট গ্রামের জমিদার। ২. রাজনারায়ণ– অতিশয় ধনী ও হৃদয়বান, অতিশয় সৌখিন খড়্গপুর থানার জকপুরের জমিদার। ৩. ছকু– ছকুরাম রায়, সদর কোতোয়ালি থানার পাথরা গ্রামের দেবভক্তি ও দেবালয় নির্মাণের জন্য খ্যাত জমিদার। ৪. নরু– নরনারায়ণ চৌধুরী। সাকিন ও থানা এগরার এই জমিদার ব্রহ্মত্তর ভূমি দানের কারণে খ্যাত হয়েছিলেন। ৫. যাদবরাম– বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁর কাছে ‘রাজা’ খেতাব পাওয়া মাজনামুঠার (বর্তমান কাঁথি শহর) জমিদার যাদবরাম ছিলেন যেন কল্পবৃক্ষ। অপরিমিত ভূমি দান করতেন, তাও প্রার্থীর চাহিদামত।
এবার চন্দ্রশেখর ঘোষ প্রসঙ্গে যাই আমরা। তাঁর জীবনকথা যেমন ঐতিহাসিক, তেমনই রূপকথার মত মনোরঞ্জনকারী। রূপকথার নায়কের মতোই তাঁর উত্থান, কিন্তু পতন ছিল না মানুষটির। প্রায় ১০০ বছর আয়ু ছিল তাঁর। ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত যুক্ত থেকেছেন ইংরেজ প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদে। এমন দৃষ্টান্ত ভূভারতে নাই।
চন্দ্রশেখরের পিতা হৃদয়রাম, পিতামহ নন্দকিশোর। হুগলির খানাকুল থেকে উঠে এসে, মেদিনীপুরের ধারেন্দা পরগণার বিক্রমপুর-কৃষ্ণনগর গ্রামে বসতি করে ঘোষ পরিবারটি। সেখানে থাকতেই মুর্শিদাবাদে নবাব দরবারে চাকুরী পান হৃদয়রাম।
একবার হৃদয়রাম বাড়িতে থাকাকালীন বর্গী আক্রমন ঘটে। নবাবের কর্মচারী জেনে, বর্গীরা হৃদয়রামকে হত্যা ও সর্বস্য লুন্ঠন করে। কেউ বলেন, সেসময় পিংলা থানার এক জ্যোতির্বেত্তা পন্ডিত হৃদয়রামের বিধবা পত্নী এবং পুত্রদের রাজবল্লভ গ্রামে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অন্যদের অভিমত, বর্গী হাঙ্গামার ১৮ বছর পরে, চন্দ্রশেখরই মা এবং ভাইদের নিয়ে রাজবল্লভ গ্রামে উঠে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই তাঁর উত্থানের সূচনা।
বাংলায় তখন বিশৃঙ্খল অবস্থা। নবাব শাসনের শেষ পর্ব। বিচক্ষণ, কর্মপটু চন্দ্রশেখর নবাব দরবারে নিযুক্ত হন। জমিজমার বন্দোবস্ত, শাসন সংক্রান্ত কাজের তদারকির ভার ইত্যাদি গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। পরে, সেই অভিজ্ঞতাই তাঁকে প্রশাসক হিসাবে ইংরেজদের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে নতুন করে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পত্তন হচ্ছে তখন। ১৭৭৬ সাল, মি: জন পিয়ার্স মেদিনীপুর জেলার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হলে, চন্দ্রশেখর তাঁর দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৭৯৩ সালে ‘ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা’ প্রচলনে সুদক্ষ ভূমিকা ছিল তাঁর। ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্বশীল কাজে তাঁকে যুক্ত রেখেছিল ইংরেজ প্রশাসন।
উচ্চ বেতন ছাড়াও, নিজের জমিদারি ছিল চন্দ্রশেখরের। যেমন উপার্জন ছিল, দানও করতেন দু’হাত খুলে। আসক্তিশূন্য চন্দ্রশেখর দেব-দ্বিজের সেবা, মন্দির প্রতিষ্ঠা, গো-ভূমি-অশ্ব-পুস্করিণী দান, অতিথি সৎকার ইত্যাদি কাজে স্মরণে রাখতেন– ‘দানে দুর্গতি খন্ডে’। চন্দ্রশেখরই শিখিয়েছিলেন– সদ্ব্যয় ও সদনুষ্ঠানেই ধনের সাফল্য। জীবদ্দশাতেই ‘দানবীর’ হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
চন্দ্রশেখরের কথা রেখে, মন্দিরের প্রসংগে যাওয়া যাক এবার। পূর্বের গ্রাম বিক্রমপুরের ৩টি মন্দির ছাড়াও, নিজের রাজবল্লভ গ্রামে ১৫টি দেবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চন্দ্রশেখর। ১টি কৃষ্ণমন্দির, ১টি কালীমন্দির ও তার সংলগ্ন দ্বাদশ শিবালয় এবং বর্তমান আলোচ্য এই শিবমন্দিরটি। এটি তিনি অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে নির্মাণ করেন বলে অনুমান করা হয়।
এখন যা দেখা যায়, তা ঠিক মন্দির নয়, মন্দিরের ভগ্নাংশ মাত্র। তাও গাছপালায় আবৃত। মন্দিরের বেশ কিছু অংশ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। অগত্যা, এই সৌধের বিবরণ তৈরির জন্য, পূর্ববর্তী পুরাবিদগণের বিবরণ, সরেজমিন ক্ষেত্রসমীক্ষা এবং সেবাইত বংশের সাক্ষাৎকার– তিন বিষয়ের উপর নির্ভর করতে হয়েছে আমাদের।
আনু. ৪০ ফুট উচ্চতার ১৭ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের দক্ষিণমুখী বর্গাকার সৌধটি ইটের তৈরী। পঞ্চ-রত্ন মন্দির, কিন্তু ৪টি রত্ন বহুকাল পূর্বেই বিলুপ্ত, কেন্দ্রীয় রত্নটিই দেখা যায় কেবল। রত্নগুলি কলিঙ্গের শিখর-দেউল স্থাপত্যধারায় প্রভাবিত। বাঢ় এবং গণ্ডী অংশ জুড়ে রথ বিভাজন করা। মাথার রত্নটিতে পঞ্চ-রথ বিন্যাস করা এবং গন্ডী অংশে পীঢ় রীতিতে থাকে কাটা। শীর্ষক অংশের বেঁকি, আমলক, ঘন্টা, কলস, ত্রিশূল– কিছুই নাই আজ আর, কিছুই।
মন্দিরের সামনের অংশে একটি অলিন্দ ছিল এক সময়। তাতে ইমারতি রীতির থাম আর দরুণ রীতির খিলানযুক্ত দ্বারপথ ছিল তিনটি। অলিন্দ অংশটি বহুকাল সম্পূর্ণ ভূপাতিত। কিছুই অবশিষ্ট নাই। গর্ভগৃহটিই কেবল টিকে আছে। অলিন্দের সিলিং গড়া হয়েছিল টানা-খিলান করে। গর্ভগৃহের সিলিং পর পর বড় খিলান এবং ছোট খিলান গড়ে, তার মাথায় গম্বুজ স্থাপন করে নির্মিত হয়েছে।
বড় যত্নে সাজিয়ে গুছিয়ে মন্দিরটি গড়েছিলেন চন্দ্রশেখর। টেরাকোটা ফলকে মুড়ে দিয়েছিলেন সামনের দেওয়ালটিকে। আমাদের দেখবার সৌভাগ্য হয়নি সেসব শিল্পকর্ম। পুরাবিদ প্রয়াত তারাপদ সাঁতরা এবং অধ্যাপক প্রণব রায়ের বিবরণ এবং ছবিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আমাদের। প্রণব রায় বলেছেন– “উচ্চমানের পোড়ামাটির বহু মূর্তি ছিল। নকশাকাজও বেশ ছিল।”
আমরা কেবল মাথার রত্নটুকুই আজ দেখতে পাই। সেখানে প্রতিটি রথ অংশে টেরাকোটার তৈরী বড় আকারের অনেকগুলি ফুল এখনও টিকে আছে। আর আছে শিবলিঙ্গ পূজা-র ছোট একটি ফলক। দক্ষিণ দিকের রাহাপাগ অংশে আছে এই ফলকটি।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী সুশান্ত ঘোষ, প্রশান্ত ঘোষ– বার্জ টাউন, মেদিনীপুর শহর। কানাই শীট– রাজবল্লভ।
পথ-নির্দেশ : মেদিনীপুর-ময়না বাস রাস্তায়, মুন্ডমারী পার হয়ে, রাজবল্লভ গ্রাম। কালীমন্দির স্টপেজে নেমে/থেমে, বাম হাতে ঘোষেদের এই মন্দির।