Homeএখন খবরজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ১০৮ ; চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ১০৮ ; চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ১০৮                                                              চিন্ময় দাশধর্ম মন্দির, পাথরা (থানা– কোতোয়ালি। মেদিনীপুর)

অষ্টাদশ শতকের একেবারে মধ্যভাগ তখন। আলীবর্দী খাঁ (শাসনকাল ১৭৪০ – ১৭৫৭) বাংলার সুবেদার। জনৈক বিদ্যানন্দ ঘোষাল ছিলেন তাঁর এক দেওয়ান। অতি বিশ্বস্ত কর্মচারী। বর্তমান কলকাতার এড়িয়াদহ এলাকার অধিবাসী ছিল এই ঘোষাল পরিবার। সেই বংশে রাঘবরাম ঘোষাল ছিলেন সংস্কৃত ভাষা এবং হিন্দুশাস্ত্রে সুপন্ডিত। তাঁরই জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন বিদ্যানন্দ। তিনিও সুশিক্ষিত। সৎ, ধর্মপ্রাণ মানুষ। নিজের চরিত্রগুণে নবাবের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। সেই সূত্রে, দেওয়ানির পাশাপাশি, নিজে মেদিনীপুর জেলায় একটি জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

মেদিনীপুর নগরীর গা ছুঁয়ে কংসাবতী নদী পূর্বমুখে প্রবাহিত হয়েছে তার নিম্ন স্রোতে। নদীর তীর বরাবর শহর থেকে সামান্য পূর্বদিকে পাথরা গ্রাম। সেখানেই নদীর কূলে, নিজের অট্টালিকা, কাছারিবাড়ি ইত্যাদি নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন বিদ্যানন্দ। নবাবের কাছ থেকে ‘মজুমদার’ খেতাব পেয়েছিলেন তিনি। (সুবল চন্দ্র মিত্র ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’ গ্রন্থে মজুমদার শব্দের অর্থ বলেছেন– ” মৌজাদার, প্রাচীন কালের ভূস্বামীর উপাধি; উপাধিবিশেষ।সং. “) তখন থেকে কৌলিক
‘ঘোষাল’ পদবী ত্যাগ করে, ‘মজুমদার’ পদবী ব্যবহার করে আসছে বিদ্যানন্দের বংশ।
বংশ বৃদ্ধি হতে থাকলে, মজুমদারেরা ছাড়াও, বিগত পৌনে তিনশ’ বছরে, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় পদবীর কয়েকটি পরিবার দৌহিত্রসূত্রে এই জমিদারীর শরিক হয়েছিলেন। পাথরায় এসে বসতি করেছিলেন তাঁরা। কালে কালে ৫০টির বেশি মন্দির নিয়ে, পাথরা যে “মন্দিরময়গ্রাম” হয়ে উঠেছিল, তাতে এই সবগুলি বংশেরই অবদান আছে। জমিদারি পেয়ে সকলেই দেবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরগুলির সিংহভাগই শিব এবং বিষ্ণুর। ছিল একটি দূর্গামন্দিরও। এর বাইরে দু’-তিনটি মন্দির নির্মিত হয়েছিল শীতলা এবং এই ধর্মঠাকুরের। আজকের জার্নালের আলোচনা ধর্মমন্দিরটি নিয়ে।
মন্দিরে কোনও প্রতিষ্ঠালিপি নাই। তবে স্থাপত্য বিচার করে পূর্ববর্তী পুরাবিদগণের অভিমত, অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। সেই হিসাবে আমাদে রঅভিমত, বিদ্যানন্দ মজুমদারের হাতেই এটি নির্মিত হয়েছিল, এমন অনুমান করা যেতে পারে।
ভাষাবিদগণের অভিমত, ধর্মঠাকুর আদিতে ছিলেন অনার্য জনগোষ্ঠীর দেবতা। ‘ধর্ম’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে কোল ভাষার ‘দড়ম’ শব্দ থেকে (দড়ম > দরম > ধরম > ধর্ম– এই ভাবে)। কোল ভাষায় দড়ম শব্দের অর্থ– কচ্ছপ বা কূর্ম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, উত্তল গড়নের কূর্মাকৃতি একটি পাথরখণ্ডই ধর্মঠাকুর হিসাবে পূজিত হয়ে থাকেন। এই মন্দিরের বিগ্রহটিও এমনই একটি পাথরখন্ড।
কংসাবতী নদীর একেবারে গা-লাগোয়া করে মন্দিরটি নির্মিত। নদীর ভাঙ্গনে মন্দির ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলে, বিগ্রহটি পুরোহিতের পরিবারে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই তাঁদের পারিবারিক দেবতাদের সাথে তিনি পূজিত হচ্ছেন।
নদীর জলস্রোত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে শূন্য মন্দিরটি– অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। দেবতা নাই মন্দিরে– ভক্তজনেরা তো যায়ই না। কিছুটা পথ আল ভেঙে পার হতে হয়। পাথরার পর্যটকদের বহু জনেরই আগমণ ঘটে না নদীতীরের নিঃসঙ্গ সৌধটিতে।
ইটের তৈরি দক্ষিণমুখী মন্দিরটি পঞ্চ-রত্নরীতির। মন্দিরের পাদপীঠ অংশটি সম্পূর্ণই বিলুপ্ত। বহুকাল আগেই ভূমিগত হয়ে গিয়েছে। প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ রাখা হয়েছিল দেবতাকে পরিক্রমা করার জন্য। সেটুকুই কেবল দেখা যায় এখন। ১৬ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের বর্গাকার মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট।
দুটি অংশ এই মন্দিরের– সামনে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারযুক্ত একটি অলিন্দ। ‘কলাগেছিয়া’ রীতির ৮টি করে গোলাকার গুচ্ছস্তম্ভের সাহায্যে দ্বারপথগুলি রচিত। অলিন্দের পিছনে এক-দ্বারী গর্ভগৃহ। সেই দ্বারপথের দু’দিকে দুটি ‘প্রতিকৃতি-দ্বার’ রচিত আছে।
অলিন্দের সিলিং বা ভিতরের ছাদ হয়েছে ‘টানা-খিলান’ করে। আর গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে চারদিকের দেওয়ালে চারটি ‘চাপা-খিলান’ গড়বার পর, সেগুলির মাথায় ছোট গম্বুজস্থাপন করে। মন্দিরের বাইরের ছাউনি চালা-রীতির। তবে, উল্লেখ করার বিষয় হল, চালের জোড়মুখগুলি উত্তল নয়। অবতল ভঙ্গিতে নির্মিত। এই রীতি ‘বিষ্ণুপুরী-চালা’ নামে পরিচিত।
মন্দিরের রত্নগুলি ‘শিখর-দেউল’ রীতিতে নির্মিত। এবং রথ-বিন্যাস করা। কোণের রত্ন চারটিতে ‘ত্রি-রথ’ এবং কেন্দ্রীয় প্রধান রত্নে ‘সপ্ত-রথ’ বিন্যাস। রত্নগুলির শীর্ষক অংশ সম্পূর্ণ বিনষ্ট। নিশান-দন্ডটি ছাড়া বেঁকি, আমলক, কলস ইত্যাদি কিছুই অবশিষ্ট নাই আর।
সামনের দেওয়ালে, কার্নিশের নীচ বরাবর দুটি সারিতে ছোট ছোট খোপে এবং তিনটি দ্বারপথের মাথার উপর তিনটি বড় প্রস্থে, পঙ্খের ফুলকারী নকশার কাজ আছে। এছাড়া, মন্দিরে কোনও অলংকরণ নাই।
মন্দিরের সামনে একটি স্থাপত্য নিদর্শন দেখা যায়। অনুচ্চ একটি গোলাকার স্তম্ভ। উপরের অংশটি কড়াইয়ের মত। ‘গোটখাল’ নামে পরিচিত সেটি। ধর্ম সংক্রান্তির দিনে এখানে শিশুদের মস্তক-মুন্ডন হয়, মানতশোধের জন্য। এছাড়া, ভাদ্র মাসে রাধাষ্টমীর আগের দিন ওল, কচু, মানকচু, শালুকফুল ইত্যাদি দিয়ে পূজা করতে দেখা যায় ভক্তদের।
মন্দিরের পদতল ছুঁয়ে কংসাবতী নদী প্রবহমান। পাথরার অনেকগুলি মন্দির পূর্বেই নদীর স্রোতে ভেসে গিয়েছে। এবার এই মন্দিরের পালা। সেই ভয়ে দেবতা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দ্রুত উদ্যোগ না নিলে, এই মন্দিরটিও ভেসে যাবে একদিন।
সাক্ষাৎকার : প্রয়াত প্রদ্যোৎভট্টাচার্য্য, শ্রীমতি ছায়ারানি ভট্টাচার্য্য, শ্রী সুধাংশু শেখর ভট্টাচার্য্য, শ্রী প্রভাস ভট্টাচার্য্য (পাথরা পরিক্রমার গাইড)– বিন্দাপাথরা। শ্রী জয়ন্ত সামন্ত– পাথরা। মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান– হাতিহলকা।
পথ-নির্দেশ : মেদিনীপুর শহর থেকে পূর্বমুখে, কাঁসাই নদীর উত্তর তীর বরাবর পাকা রাস্তায়, ৮ কিমি দূরে পাথরা।পথের ডাইনে নদীর গায়েই মৃত্যুপথযাত্রী মন্দিরটি অবস্থিত।

RELATED ARTICLES

Most Popular