বিভূ কানুনগো : শনি-রবি দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটির পর সোম আর মঙ্গলবার বন্ধ থাকছে ব্যাংক। না, হয়ত বন্ধ থাকবেনা কিন্তু ব্যাংকে গিয়ে আপনি কোনও পরিষেবা পাবেননা কারন ওই দু’দিন সারা ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কর্মচারী ও অধিকারিকদের প্রায় ১০০শতাংশই এই ধর্মঘটে অংশ নিচ্ছেন। না ব্যাংক কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, সুযোগ সুবিধা প্রদান ইত্যাদি নিজেদের দাবি দাওয়া নিয়ে নয়। এই ধর্মঘট হচ্ছে অন্য একটি কারনে যে কারন গুলি ব্যাখ্যা করতে হাটে বাজারে মাইক নিয়ে প্রচারে নামতে দেখা গেল ব্যাংক কর্মী ও আধিকারিকদের।
এমনটা নয় যে এর আগে ব্যাংক কর্মীরা এভাবে মাঠে নামেননি কিন্তু এবার তাঁরা যে ভাবে ময়দানে নেমেছেন তেমনটা এর আগে কখনও নামেননি। খড়গপুর শহরের মালঞ্চ, কৌশল্যা, প্রেমবাজার, ডিভিসি ইত্যাদি বাজারে ইতিমধ্যেই প্রচার সেরে ফেলেছেন তাঁরা। প্রচার চলছে বাকি বাজার গুলিতেও। একই ভাবে রাজ্যে এবং দেশজুড়েও হাটে বাজারে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
ব্যাংক কর্মচারীরা বলছেন, ১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই ভারতে ব্যাঙ্ক জাতীয়করন করা হয়। ভারতের ১৪টি বৃহৎ বেসরকারি আর্থিক লেনদেনের প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা হয়। নির্মিয়মান, গরিব এবং যুদ্ধক্লান্ত দেশকে সামনের সারিতে তুলে আনতে এই পদক্ষেপকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবেই আজও মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যক্তিগত ভাবে এই বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি মানুষকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছিল। আজকের সারদা, রোজভ্যালির মতই জালিয়াতি করে দেশের কোটি কোটি মানুষের সঞ্চিত অর্থ লুট করে বসে যাচ্ছিল এবং নতুন করে আরেকটি ব্যাঙ্ক খুলে বসছিল নতুন করে লুটের জন্য।
ব্যাঙ্ক জাতীয়করনের ফল হিসাবে সেই জালিয়াতির ওপর তো নিয়ন্ত্রণ এলই কিন্তু তারও বড় সুদ হিসাবে আসল একটি গরিবদেশকে আধুনিকভাবে নির্মাণের জন্য অভূতপূর্ব সহায়তা। ১৯৬২ এবং ৬৫ ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনের সংঘর্ষ নয়া ভারতের অর্থনীতিতে জোরালো আঘাত হানে। এরপর দু’দুটি তীব্র খরা দেশের খাদ্যভান্ডার প্রায় নিঃশেষ করে দেয়। এই জায়গা থেকে ভারতের তখন দুটি উদ্দেশ্যে এক শিল্প ও সড়ক সহ আধুনিক পরিকাঠামো নির্মাণ, অন্যদিকে সবুজ বিপ্লবের মত কর্মসূচি নিয়ে ভারতকে খাদ্যে স্বনির্ভর করে তোলা। যাঁরা বুলগার, মাইলো ইত্যাদির ইতিহাস জানেন তাঁরা বুঝবেন সেই খাদ্য সঙ্কটের তীব্রতা কেমন ছিল।
ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের ১বছরের মধ্যেই মানুষের আস্থা এতটাই বেড়েছিল যে, ভারতের জাতীয় আয়ে গার্হস্থ্য সঞ্চয়ের (সেভিংস আ্যকাউন্ট) পরিমান দ্বিগুন হয়ে যায়। ব্যাঙ্ক গুলি এমন জায়গায় শাখা খুলতে শুরু করে যেখানে ব্যাঙ্ক ছিলনা। ব্যাঙ্কগুলিকে সেই সমস্ত জায়গায় বিনিয়োগ করতে বলা হয় যেখানে দেশের পুনর্গঠনের কাজে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত রয়েছে। সড়ক, শিল্প, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিক্ষেত্র গবেষনা ইত্যাদি কাজে অর্থ বিনিয়োগ হতে শুরু করে। আজকের যে ভারতের ছবি আমরা দেখতে পাই এর পেছনে ব্যাঙ্ক জাতীয়করনের ভূমিকা অসীম। সুতরাং ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরন বা বিক্রি করে দেওয়ার মধ্যে কেবলমাত্র সেই ব্যাঙ্কগুলির কয়েক হাজার কর্মীর বিপন্নতাকেই প্রধান বলে মনে করছেন তাঁদের জানা উচিত যে এই বিপন্নতা সমগ্র দেশের এবং জাতির। আমরা আসলে আমাদের সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকেই বিক্রি করে দিচ্ছি যে সোনা পাওয়ার জন্য আমাদের অন্যের কাছে হাত পাততে হবে। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির সম্মিলিত কর্মী ও আধিকারিকদের
সংগঠন ‘ইউনাইটেড ফোরাম অফ ব্যাংক ইউনিয়ন্স’ বা BPBEA-এর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সহ সম্পাদক ব্রীজেশ পান জানিয়েছেন, ” সাধারণ মানুষ আই সিআইসিআই বা এইচডিএফসির মত বেসরকারি ব্যাঙ্কের চৌকাট মাড়াতেই ভয় পায়। কেন? কারন ১০হাজার টাকার নীচে ওখানে খাতা খুলতেই পারবেননা। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অত্যন্ত কম টাকা এমনকি শূন্য লগ্নিতেও খাতা খুলে থাকে। সরকারের সমস্ত সাধারণ মানুষের জন্য প্রকল্প জনধন যোজনা থেকে বার্ধক্যভাতার দায়িত্ব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক নিয়ে থাকে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে খুব তাড়াতাড়ি সরকারি ব্যাংকগুলো বিক্রি করে দিতে। এর ফলে ব্যাংকে আপনার জমা টাকা সুরক্ষিত থাকবে না। সামাজিক বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাংকের ভূমিকা বিলুপ্ত হবে। ছোট চাষী, ছোট শিল্প মালিক, কুটির শিল্পী ও বেকাররা ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাবে না। গ্রাম ও শহর এলাকায় ব্যাংকের আনেক শাখা বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যাংকে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ আর থাকবে না। ১৯৬৯য়ের আগের মত জনগনের টাকা ডুবিয়ে যেকোনো সময় দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।”
ব্রীজেশ বলেন, “ব্যাঙ্ক কর্মী ও অফিসাররা চাইছেন,
সর্বনাশের ব্যাংক বেসরকারিকরণের প্রচেষ্ঠা বন্ধ হোক। ব্যাংকে আমানতকারীদের জমা টাকা সুরক্ষিত থাক। স্থায়ী আমানতে সুদের হার বাড়ানো হোক। সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে যথেচ্ছ সার্ভিস চার্জ কাটা বন্ধ হোক। সামাজিক প্রকল্পে ব্যাংক গুলো আরো বেশি করে যুক্ত হোক।
ক্ষুদ্রঋণ সহজলভ্য হোক। ঋণ খেলাপিদের ঋণ মুকুব না করে তা আদায় করতে কঠোর আইন প্রয়োগ হোক এবং ব্যাংক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিক। এই দাবি গুলি নিয়েই ইউনাইটেড ফোরাম অফ ব্যাংক ইউনিয়ন্সের ডাকে আগামী ১৫ই ও ১৬ই মার্চ । যা সফল করার জন্য আমজনতার সমর্থন চাইতে প্রচার চালাচ্ছি আমরা।”