পলাশ খাঁ, গোয়ালতোড় :- টুসু মন্দা। তবুও স্বামীর পথ্য আর সংসার চালাতে রাত জেগে টুসু বানাচ্ছেন অলকা চালক৷ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোয়ালতোড়ের মাইলিসাই এর বাসিন্দা অনীল চালকের স্ত্রী অলকা চালক। হতদরিদ্র পরিবারে স্বামী আর তিন নাতি নাতনী কে নিয়ে সংসার অলকার। ৪০ বছর আগে স্বামীর হাত ধরে বাপের বাড়ির মায়া ত্যাগ করে শ্বশুর বাড়িতে এসেছিলেন। তারপর স্বামীর কাছ থেকেই টুসু বানানোর হাতেখড়ি। দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে স্বামীর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সংসারের আয় বাড়াতে টুসু তৈরি করে গোয়ালতোড়, রামগড়, লালগড় সহ এলাকার বিভিন্ন হাটে হাটে গিয়ে এই টুসু বিক্রি করতেন৷ কিন্তু গত প্রায় আট দশ মাস স্বামী অনিল চালকের প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়ার কারনে সংসার চালাতে এখন অলকা নিজেই রাত জেগে টুসু বানাচ্ছেন। আর তার এই কাজে সহযোগিতা করছে নাবালিক নাবালিকা এক নাতি দিব্য আর দুই নাতিনি দেবারতি আর মিনু।
অলকার স্বামী অনিল চালকের ছোটো বেলা থেকেই মাটির কাজের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। সেজন্য ফাঁকা সময় পেলেই পুকুর পাড়ে মাটির ঢেলা নিয়ে প্রতিমা করতেন নিজের খেয়ালেই। এই জন্য মাঝে মাঝে মা বাবার বকুনিও খেতে হয়েছে। কিন্তু আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া অনীলের সখ থাকলেও তা পুরণ করতে পারেন নি। বাবা মারা যাওয়ার পর বিয়ে করে সংসারের হাল ধরেন তিনি। পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। এরই মাঝে সরস্বতী, লক্ষী, বিশ্বকর্মা, টুসু ভাদু প্রভৃতি প্রতিমা গড়তেন টুকটাক। স্ত্রী এক ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে কোনোরকমে সংসার চালিয়ে নিতেন। পরে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি পাকাপাকি ভাবে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু করেন বেশী রোজগারের আশায়। সেই সময় প্রতিমার দাম কম থাকলেও চাহিদা ছিল প্রচুর। ফলে লাভও হতো ভালো। পরে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে ছেলেরও বিয়ে দেন। ছেলের দুই মেয়ে হয়। কিন্তু বছর দশেক আগে ছেলে মারা যায় রোগে। তারও কিছুদিন পর পুত্রবধূ পরকিয়ার কারনে শ্বশুর শ্বাশুড়ি কে ছেড়ে অন্য একজনের সাথে পালিয়ে যায় নিজের নাবালক নাবালিকা দুই সন্তান কে ফেলে রেখে। তখন থেকেই ছেলের দুই সন্তান আর মেয়ের এক মেয়েকে নিজেদের কাছে রেখেই মানুষ করে চলেছেন অনীল আর অলকা। কিন্তু গত আট দশ মাস আগে হটাৎ করেই অনিল প্যারালাইসিস হয়ে পড়ে৷ ফলে সংসারের হাল ধরতে হয় অলকাকেই। দীন দরিদ্র অলকা জন মজুরী করে দিন গুজরান করছেন কোনো রকমে। তার উপর স্বামীর প্রতিমাসে দুই হাজার টাকার ঔষধ খরচ৷ অথচ সরকারি ভাবে পাইনি কোনো সাহায্য৷ স্বামীর বয়স ষাট পেরিয়ে গেলেও জুটেনি বার্ধক্য ভাতা৷ অলকা জানান “বিডিও অফিসে গিয়ে আবেদন করার পরেও এই ভাতা চালু হয়নি কি কারনে জানিনা। বার্ধক্য ভাতার এক হাজার টাকা মাসে মাসে পেলেও কিছুটা সুরাহা হতো”৷
পৌষ সংক্রান্তীতে জঙ্গলমহলে টুসুর ব্যাপক চাহিদা ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা যেন বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলছে। অলকা চালক জানান, আমরা দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে গোয়ালতোড় সহ আশেপাশের হাটে টুসু বিক্রি করছি। কিন্তু দু তিন বছর ধরে টুসুর চাহিদা যেন কমে যাচ্ছে। গত বছর প্রায় ১০০০ এর মত টুসু করে ছিলাম কিন্তু ২০০ র মতো টুসু রয়ে গিয়েছিল। এবার সেজন্য ছোটো বড়ো মিলিয়ে ৭০০ র মতো টুসু করছি। এবার একাই করতে হচ্ছে। দিনের বেলাতে সময় পাই না বলেই রাত জেগে টুসু তৈরি করতে হচ্ছে৷
কি কারনে টুসুর এমন মন্দা তা জানেন না অলকা । তবে বাজারে অন্যান্য জিনিসের মতো টুসুর দাম কিন্তু সেভাবে বাড়েনি৷ ২০, ৩০, ৫০, ১০০ টাকা মুল্যের টুসুও বিক্রি হচ্ছে না। অলকা জানান, শ্বশুর বাড়িতে আসার পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে টুসু গড়ার কাজ আরম্ভ করেছি। এই টুসু বিক্রি করেই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। তাই সেই টুসু গড়ার কাজ এখনো বন্ধ করিনি। জানি টুসুতে মন্দা চলছে তবুও রুজীর টানে এই ব্যাবসা করে চলেছি। শুনেছি প্রশাসনিক ভাবে এখন টুসু নিয়ে নানান কর্মশাল হচ্ছে। টুসু পুজো নিয়ে মানুষ কে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। তাই হয়তো বা আবার কোনোদিন টুসুর বাজার ফিরবে।