জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৫৭
ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ মন্দির, পাঁচরোল (এগরা-২)
চিন্ময় দাশ
ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ায় চৈতন্যদেব প্রেমধর্মের প্রচার করেন। সেই অভিঘাতে নতুন করে বহু বিষ্ণুমন্দির নির্মিত হয়েছিল বাংলায়। কেবল চৈতন্য-নিত্যানন্দের বিগ্রহ রেখে ‘মহাপ্রভু’ নামের মন্দিরও কম নির্মিত হয়নি। জানা যায়, পুরীধামে থাকাকালীন চৈতন্যদেব একবার নিত্যানন্দ এবং কয়েকজন পার্ষদকে ষড়ভূজ রূপ ধারণ করে দেখিয়েছিলেন। কোন কোনও মন্দিরে চৈতন্যদেবের সেই ‘ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ’ মূর্তিও দেখা যায়। কিন্তু আজকের জার্নালে এমন বিশিষ্ট এক মন্দিরের বিবরণ, যেখানে কেবল ‘ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ’ মূর্তিই পূজিত হচ্ছেন।
গৌরাঙ্গ ঠাকুর কিংবা তাঁর মন্দিরের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, মন্দির প্রতিষ্ঠাতার বিষয়ে খানিক চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণের এলাকায় মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠাতার পরিবারের আদি নিবাস ছিল ভারতের পশ্চিমতম প্রান্তে, সৌরাষ্ট্র এলাকায়। দিল্লি দখলের পর, আলাউদ্দিন খিলজির বারংবার রাজপুতানা আক্রমণের কারণে, প্রাণ এবং স্বধর্ম রক্ষায় দেশত্যাগ করে চলে আসতে হয়েছিল বহু শোলাংকি পরিবারকে। তীর্থদর্শনের নামে, ভারতের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। তেমনই বেশ কয়েকটি পরিবার জগন্নাথ দর্শন সেরে, পুরীর আশেপাশে স্থায়ী বসতি করে নিয়েছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার কথা এটি।
এদিকে মেদিনীপুর জেলার প্রায় সমস্তটাই ওডিশার রাজাদের শাসনে ছিল দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। সেই সময়কাল থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বহু বনেদি ও সম্ভ্রান্ত পরিবার ওডিশা থেকে মেদিনীপুর জেলায় এসে বসতি করেছিলেন। এসেছিলেন কিছু ভাগ্যান্বেষী উদ্যমী পুরুষও।
এদিকে, রাজপুতানা থেকে আসা শোলাঙ্কিদের একটি শাখা বসত করছিলেন পুরী জেলার কাঁশবাঁশ গ্রামে। নিরাপত্তার কারণে, জাতি ও পরিচিতি গোপন করে নিতে হয়েছিল তাঁদের। রাজপূত ক্ষত্রিয় থেকে ‘ রাজু ‘ জাতি এবং ‘ দাস মহাপাত্র ‘ পদবি গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়। সেই গ্রাম থেকে জনৈক নারায়ণ দাস মহাপাত্র ভাগ্যসন্ধানে মেদিনীপুর জেলায় চলে এসেছিলেন। জেলার দক্ষিণের এলাকা শীপুর পরগণার (বর্তমান এগরা থানা) পাঁচরোল গ্রামে এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন তিনি।
ধান-চালের ব্যবসায় হাত দিয়েছিলেন নারায়ণ। গ্রামের অদূরেই চম্পা নদী। তার জলপথে দূর-দূরান্তর পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানির সুবিধা। ব্যবসা বিস্তারেরও বিশেষ সুবিধা তাতে। কিছুকাল পরেই দেখা দিয়েছিল ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ (ইং ১৭৬৯ – ১৭৭৩ সাল)। সেই সময়কালে ব্যবসা থেকে বিপুল সম্পদের মালিক হন নারায়ণ। নবাব দরবার থেকে সনন্দ নিয়ে, একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। গড়খাই কেটে বিশাল মাপের বাস্তু ঘিরেছিলেন। তা থেকে নাম হয়– পাঁচরোলগড়। পরে, এই জমিদারবংশ ” চৌধুরী ” খেতাব পেয়েছিল রাজ্-দরবার থেকে।
জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে, বসতবাড়ির সাথে বিশাল আকারের একটি কৃষ্ণমন্দির স্থাপন করা হয়েছিল। বিগ্রহের নাম– রাধাবিনোদজীউ। (১২.০৭.২০২০ তারিখে ৪৫ নং জার্নালে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে।) নারায়ণ-এর পরবর্তী ৬ষ্ঠ পুরুষে জমিদারবংশের একটি অংশ বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। সেই অংশের জমিদার ছিলেন চৌধুরী নিমচরণ দাস মহাপাত্রের পুত্র চৌধুরী কৃষ্ণগোবিন্দ (ওরফে কৃষ্ণমোহন) দাস মহাপাত্র। তিনি বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা নিয়ে, নতুন করে দুটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একটি কুলদেবতা মদনমোহন, এবং অন্যটি আজকের জার্নালের আলোচ্য ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ মন্দির।
সেই সময়কালের মেদিনীপুর জেলায় এই জমিদারবংশের উল্লেখযোগ্য অবদান আছে, বিশেষত শিক্ষাবিস্তার এবং স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনে। অপরদিকে এঁরা ছিলেন ধর্মপ্রাণ। তিনি-তিনটি মন্দির প্রতিষ্ঠা তার বড় প্রমাণ।
জমিদারের ইতিহাস আলোচনা অনেক হোল। এবার বিগ্রহ নিয়ে দু’চার কথা বলা যেতে পারে। স্বামী কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষা নিয়ে, জগন্নাথধাম পুরি গিয়েছিলেন চৈতন্যদেব। সাথে নিত্যানন্দ, মুকুন্দরাম প্রমুখ কয়েকজন সহচর। সেখানে স্বয়ং পুরিরাজ ওডিশার সূর্যবংশীয় নৃপতি গজপতি মহারাজা প্রতাপরুদ্র দেব এবং রাজার তত্ত্বজ্ঞানী সভাপন্ডিত সার্বভৌম ঠাকুরের সাথে বিশেষ হৃদ্যতা জন্মায় তাঁর। তিনি পুরীতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে, নিত্যানন্দকে বাংলায় ফিরে গিয়ে বৈষ্ণবধর্ম প্রকারের নির্দেশ দেন। তাতে নিত্যানন্দ ও অন্যান্য পার্শ্বচরেরা বিচ্ছেদব্যথায় কাতর হয়ে পড়লে, চৈতন্যদেব ‘ষড়ভূজ’ রূপ ধারণ করে তাঁদের সামনে প্রকাশিত হয়েছিলেন।
১. চৈতন্যচন্দ্রামৃত (দাক্ষিণাত্যের পন্ডিত প্রবোধানন্দ সরস্বতী-র কোষকাব্য), ২. চৈতন্যচন্দ্রোদয় ( কবি কর্ণপুর-এর সংস্কৃত নাটক), ৩. শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত (কৃষ্ণদাস কবিরাজ-এর কাব্য), ৪. শ্রীচৈতন্য ভাগবত (বৃন্দাবন দাস ঠাকুর), ৫. শ্রীচৈতন্যমঙ্গল (লোচনদাস ঠাকুর), ৬. চৈতন্যলীলা (গিরিশ চন্দ্র ঘোষ-এর নাটক) ইত্যাদি বহু গ্রন্থ আছে চৈতন্যজীবনীকে আধার করে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ-এর বিখ্যাত শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত কাব্যে চৈতন্যদেবের ষড়ভূজ রূপ ধারণ সম্পর্কে উল্লেখ আছে– ” তবে নিত্যানন্দ স্বরূপের আগমণ। প্রভুকে মিলিয়া পাইলা ষড়ভূজ দর্শন।। প্রথমে ষড়ভূজ তাঁরে দেখাইল ঈশ্বর। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-শার্ঙ্গ-বেণুধর।। পাচ্ছে চতুৰ্ভূজ হইলা তিন অঙ্গ বক্র। দুই হস্তে বেণু বাজায় দুয়ে শঙ্খ চক্র।। তবে ত’ দ্বিভূজ কেবল বংশীবদন। শ্যাম-অঙ্গ পীত-বস্ত্র ব্রজেন্দ্রনন্দন।। … তবে সপ্ত প্রহর ছিলা প্রভু ভাবাবেশে। যথা তথা ভক্তগণ দেখিল বিশেষে।। ”
মন্দিরের বিগ্রহটি হুবহু এইমত নির্মিত হয়েছে। ৬টি বাহুবিশিষ্ট বিগ্রহে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীবলভদ্র ৩ দেবতা প্রকাশিত। উপরের পীত (সবুজ) বর্ণের দুটি হাতে রামচন্দ্রের ধনুক ও বাণ। মাঝখানের কৃষ্ণবর্ণ দুটি হাতে শ্রীকৃষ্ণের মুরলী। আর, নীচের হলুদ বর্ণের হাত দুটিতে বলরামের গদা ও কমণ্ডলু। এই মূর্তিই স্থাপিত হয়েছে বিশাল আকারের একটি মন্দির গড়ে।
দাক্ষিণাত্য এলাকার ‘ফোর্ট টেম্পল’ বা ‘দুর্গ মন্দির’ যেন। গভীর পরীখা কেটে, ঘেরা হয়েছিল মন্দিরকে। ইটের তৈরী, দালান-রীতির, পূর্বমুখী দেবালয়। একেবারে রাজকীয় বিস্তার এই সৌধটির। সামনের অংশের বিস্তার ২৭ ফুট, আর দুই পাশ, অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ অংশে সাড়ে ৪৩ ফুট বিস্তার। একতল বিশিষ্ট মন্দির, কিন্তু উচ্চতা দ্বিতলকেও ছাড়িয়ে যায়– সোয়া ৩৭ ফুট। এত বিশাল দালান মন্দির মেদিনীপুর জেলায় বুঝি আর নাই।
মন্দিরের চারদিক জুড়ে চারটি প্রশস্ত অলিন্দ, ‘প্রদক্ষিণ-পথে’র মত, মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে। সামনে ৩টি আর, পাশের দু’দিকে ৫টি করে– মোট ১৩টি দ্বারপথ অলিন্দে প্রবেশের। পূর্বদিকে অলিন্দ থেকে গর্ভগৃহের মূল দ্বারপথটি ছাড়া, উত্তরে একটি অতিরিক্ত দ্বারও আছে। সবগুলি দ্বারই খিলান-রীতিতে রচিত।
পিছনে, অর্থাৎ মন্দিরের পশ্চিমের অংশে, একটি সিঁড়ি রচিত হয়েছে উপরে যাবার জন্য। প্রায় সওয়া ১ ফুট উচ্চতার ২০টি ধাপ বিশিষ্ট।
বিশাল এই মন্দিরের ভিতরের ছাদ বা সিলিং কীভাবে গড়া হয়েছে, দেখা যেতে পারে। অলিন্দ চারটির সিলিং-এ দেখা যায়, অর্ধ-গোলাকার ‘টানা-খিলান’ গড়ে, মাথার ছাউনি ধরে রাখা হয়েছে। গর্ভগৃহটিও বিশাল। তার সিলিং হয়েছে ভিন্ন রীতিতে, হুবহু শিখর বা রত্ন মন্দিরের মত করে। প্রথমে সামনে পিছনে দু’দিকে দুটি বড় খিলান। এবার সে দুটির মাথায়, বিপরীত দু’দিকে আবার বড় মাপের দুটি খিলান। এই খিলান চারটি ধরে রেখেছে মন্দিরের মাথার ভারী আর সমতল ছাদকে।
অলংকরণের কিছু কাজ আছে মন্দিরে। পঙ্খের কাজ আর টেরাকোটা ফলক– এই দুইয়ের সমাহারে সাজানো মন্দির। মন্দিরের ছাদ সমতল, সেকারণে, কার্ণিশগুলি সরলরৈখিক। সামনের কার্ণিশের উপরের আলসেটিকে সাজানো হয়েছে যত্ন করে। পাঁচটি চতুস্কোণ ব্লক। পাঁচটিতেই মূর্তিবিন্যাস করা। কেন্দ্রীয় ব্লকের মূর্তিটি ‘ষড়ভূজ গৌরাঙ্গ’-এর।
কার্ণিশের নীচ থেকে সামনের দেওয়ালের সমস্ত অংশ জুড়ে, ফুলকারী নকশায় উৎকৃষ্ট পঙ্খের কাজের নমুনা দেখা যাবে এখানে। তার ভিতর উপর দিকে একটি সারি টেরাকোটা ফলক দিয়ে সাজানো। সেখানে বাদ্যযন্ত্রসহ কীর্তনরত বৈষ্ণবমন্ডলী রূপায়িত হয়েছে। একটি ‘মিথুন-ফলকও দেখা যায় সেখানে।
দালান-মন্দির হলেও, একটি শীর্ষক বা চূড়া রচিত হয়েছে মন্দিরের মাথায়। গৌরাঙ্গ-মূর্তির মাথা বরাবর, আলসের কেন্দ্রীয় ভাগে, শিখর-রীতিতে একটি রত্ন নির্মাণ করা হয়েছে। তার ‘বাঢ়’ এবং ‘গণ্ডী’ জুড়ে ‘ত্রি-রথ’ বিভাজন করা। গন্ডী অংশে ‘পীঢ়-রীতি’ প্রয়োগ করে, পঞ্চ-পীঢ় রচনা করা হয়েছে। মাথায় বেঁকি, আমলক, কলস, চক্র রচিত হলেও, আজ কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। কেবল লৌহদন্ডটি টিকে আছে অতীতের সাক্ষী হয়ে।
সামনের অলিন্দে মূল দ্বারপথের দু’দিকে বড় আকারের দুটি ময়ূর রচিত হয়েছিল। সে দুটিও ভারী জীর্ণ। তবে, শীর্ষক অংশের দু’দিকে, উপবিষ্ট ভঙ্গিমায় ব্যাদিতবদন দুটি সিংহমূর্তিই ধরে রেখেছে মন্দিরের রাজকীয় গরিমাকে।
পরিতাপের কথা, মন্দিরের অলংকরণগুলি অনেকদিন যাবৎ জীর্ণতার শিকার, খসে খসে পড়ছে শিল্পকর্মগুলি। দ্রুত সংস্কার আর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে সৌধটির। তা নাহলে, আমাদেরই অনাদরে অবহেলায় কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে জেলার শ্রেষ্ঠতম দালান মন্দিরটি।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী অসিত বরণ দাস মহাপাত্র, বিমল কৃষ্ণ দাস মহাপাত্র, জনার্দন সতপথী (পুরোহিত)– পাঁচরোল।
সহযোগিতা : শ্রী রাখহরি মহাপাত্র– পাঁচরোল।
পথ-নির্দেশ : মেদিনীপুর বা খড়্গপুর থেকে কাঁথিগামী রাস্তায় মহকুমা শহর এগরা। কলকাতার দিক থেকে দিঘাগামী ট্রেন বা বাসে, কাঁথি হয়েও এগরা পৌঁছানো যাবে। সেখান থেকে কশবাগোলাগামী বাসরাস্তায় পাঁচরোল গ্রাম।