জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৫৬
রাধা-দামোদর মন্দির, আলুই (ঘাটাল)
চিন্ময় দাশ
মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমা। অনেকগুলি নদীবেষ্টিত হওয়ায়, উর্বর কৃষিভূমির সুবাদে বহু পূর্বকালে থেকে এই এলাকার অর্থনীতি বেশ সমৃদ্ধ ছিল। পরে পরে গ্রামীণ হস্তশিল্প, নীলচাষ এবং বিশেষত রেশম শিল্পের সুবাদে বহু অর্থসম্পন্ন পরিবারের উদ্ভব হয়েছিল গোটা মহকুমা জুড়ে। তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন মাপের ছোট-বড় জমিদারি স্থাপন করেছিলেন। বহু মন্দিরও গড়ে উঠছিল তাঁদের হাতে। সেই ধারায় ঘাটাল থানার আলুই গ্রামের জনৈক রূপচাঁদ ভুঁঞাও একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রূপচাঁদ ভুঁঞা যখন জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন, তখন সারা বাংলা গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্লাবনে প্লাবিত। ঘরে ঘরে রাধা-কৃষ্ণ বা শ্রীহরির আরাধনা প্রবল উৎসাহে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। প্রায় সমস্ত রাজা বা জমিদার তাঁদের বাড়িতে নতুন করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে, রাধা-কৃষ্ণ বা বিষ্ণুর আরাধনার প্রচলন করেছেন।
ভূঞা বংশ পূর্বকাল থেকেই শিবের উপাসক ছিলেন। কিন্তু দেবারাধনার জন্য রূপচাঁদ নতুন করে বৈষ্ণবীয় রীতিকে আশ্রয় করেন। নতুন একটি বিষ্ণু মন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেবাপূজার প্রচলন করেন তিনি। প্রতিষ্ঠা-ফলকের উল্লেখ থেকে জানা যায়, সময় তখন ইং ১৮৬০ সাল। অবশ্য, বছর সাতেক বাদে, তিনটি শিব মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। সেই বিবরণ পরে পৃথক একটি জার্নালে প্রকাশ করব আমরা।
বিষ্ণু মন্দিরে সাধারণত মূর্তি দেখা যায় না। শালগ্রাম শিলাই বিগ্রহ হিসাবে পূজিত হয়। এই মন্দিরেও “দামোদর” নামিত একটি শালগ্রাম শিলাই স্থাপিত হয়েছে। সেই নাম থেকেই মন্দিরের নাম– রাধা-দামোদর মন্দির।
১৬০ বছর আয়ু হয়েছে এই মন্দিরের। সৌধটি প্রথম বার সংস্কার হয়েছিল বাংলা ১৩৬০সালে। সুখের কথা, পুনরায় জীর্ণ হয়ে পড়লে, সম্প্রতি মন্দিরে সংস্কার কাজ করেছেন সেবাইতরা। নবজীবন ফিরে পেয়েছে সৌধটি।
প্রায় ৩৫ ফুট উঁচু এই মন্দিরের গড়ন সম্পূর্ণ বর্গাকার– দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১৫ ফুট হিসাবে। ফুট দুয়েক উঁচু পাদপীঠের উপর একটি প্রদক্ষিণ-পথ আছে। তার উপর পূর্বমুখী সৌধটি ইটের তৈরী। গড়া হয়েছে নব-রত্ন রীতিতে।
দুটি তল এই মন্দিরের। দুটির মাথাতেই বাংলা ধারায় চালা ছাউনি। তাতে যে দুটি কার্ণিশ গড়ে উঠেছে, তার বঙ্কিম ভাবটি ভারী মনোরম, সুন্দরী রমণীর আয়ত আঁখিপল্লবের মত। তবে, রত্নগুলি ওডিশা-ধারায় শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত। রত্নগুলির বেদি, বাঢ়, বরণ্ড এবং গন্ডী– সবগুলি অংশ জুড়ে রথ-বিন্যাস করা হয়েছে। কোণের রত্নগুলিতে ত্রি-রথ এবং উপরের কেন্দ্রীয় রত্নটিতে পঞ্চ-রথ বিন্যাস করা। ওডিশা-ধারার পীঢ়-রীতির আর একটি প্রয়োগ হয়েছে রত্নগুলির গন্ডী অংশে। সেখানে ভূমির সমান্তরালে সরলরেখায় থাক কাটা হয়েছে। এই দুটি রীতির প্রয়োগে সৌন্দর্য্য বিধান হয়েছে মন্দিরে।
মন্দিরের উপর নীচ দুটি তলাতেই, সামনে প্রথমে একটি অলিন্দ। তার পিছনে গর্ভগৃহ। অলিন্দগুলিতে তিনটি করে খিলান-রীতির দ্বারপথ। গর্ভগৃহে দ্বারপথ একটিই। অলিন্দগুলির ভিতরের ছাদ বা সিলিং গড়া হয়েছে টানা-খিলান করে। গর্ভগৃহের সিলিং পাশ-খিলানের মাখায় গম্বুজ স্থাপন করে গড়া হয়েছে। একটি সিঁড়ি আছে দ্বিতলে উঠবার জন্য। দ্বিতলের গর্ভগৃহটিও প্রশস্ত। রত্নগুলির শীর্ষক অংশের বেঁকি, আমলক, কলস এবং বিষ্ণুচক্রের গড়নে কিছু রদবদল হয়েছে, দেখা যায়। সংস্কার কাজের সময় সেটি হয়ে থাকবে।
পঙ্খের কাজ এবং টেরাকোটা ফলক– এই দুইয়ের সাহায্যে অলংকৃত করা হয়েছে মন্দিরকে। ফলকের মোটিফ অধিকাংশই পৌরাণিক বিষয় নির্ভর। তার মধ্যে কয়েকটি হল– মহিষমর্দিনী দশভূজা দূর্গা, লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশের পৃথক ৪টি ফলক, বিষ্ণুর অনন্তনাগ শয্যা, রাধাকৃষ্ণ, ভগবান বিষ্ণুর দশাবতারের কয়েকটি মূর্তি, রামচন্দ্র ও সীতাদেবী, বালক কৃষ্ণ, দধিমন্থনরত মা যশোদা ইত্যাদি।
ফলকের মোটিফ হিসাবে সামাজিক বিষয়কে উপেক্ষা করা হয়নি। সেরকম কয়েকটি ফলক হল– তামাকু সেবনরত পুরুষ, মৃদঙ্গবাদক, শিঙ্গাবাদক, অশ্বারোহী সৈনিক ইত্যাদি।
চৈতন্যদেব একবার তাঁর শিষ্যদের নারায়ণ-রূপ ধারণ করে দেখিয়েছিলেন। সেই ষড়ভূজ-মূর্তি কোন কোনও মন্দিরের ফলকে স্থান করে নিয়েছে। এই মন্দিরেও ষড়ভূজ-মূর্তিটি রূপায়িত হয়েছে। কার্ণিশের নীচের সারিতে আছে ফলকটি।
এগুলি ছাড়া, গর্ভগৃহের প্রবেশপথের দু’দিকে দুটি দ্বারপাল মূর্তি, এবং সেগুলির দু’পাশে ভিনিশীয় দরজার প্রান্তে প্রতীক্ষারত দুটি দ্বারবর্তিনী মূর্তিও রচিত হয়েছে।
ফলক কিন্তু সংখ্যায় যেমন বেশি নয়, আকারেও ছোট সেগুলি। প্রথম কার্ণিশটির নীচ বরাবর সমান্তরাল একটি সারি, এবং দেওয়ালের দুই প্রান্তের দুটি খাড়া সারিতে ছোট ছোট খোপের ভিতর স্থান হয়েছে ফলকগুলির। সাধারণভাবে তিনটি দ্বারপথের মাথার খিলানের উপরে, তিনটি বড় প্রস্থে টেরাকোটার ফলক লাগানো হয়। এখানে তা করা হয়নি। এখানে দেখা যায়, সেই তিনটি প্রস্থে জ্যামিতিক প্যাটার্নে পঙ্খের নকশা রচনা করা হয়েছে।
তবে সমস্ত ফলক এবং নকশাগুলি কিন্তু বারংবার রঙের প্রলেপে তার মূল সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে, একথা অস্বীকার করা যায় না।
যাওয়া – আসা : দ.-পূ. রেলপথের পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে ঘাটাল হয়ে, কিংবা চন্দ্রকোণা রোড স্টেশন থেকে চন্দ্রকোণা হয়ে রাধানগর আসা যাবে। সেখান থেকে ২কিমি দক্ষিণে কাটান পুলে নেমে, ১ কিমি পূর্বমুখে এগোলে আলুই গ্রাম ও মন্দির।