Homeএখন খবরলকডাউনে পেটের দায়ে শিক্ষকতা ছেড়ে ফল, আনাজ বিক্রি করছেন শিক্ষকরা, কাঠগড়ায় সরকার

লকডাউনে পেটের দায়ে শিক্ষকতা ছেড়ে ফল, আনাজ বিক্রি করছেন শিক্ষকরা, কাঠগড়ায় সরকার

ওয়েব ডেস্ক: লকডাউনে থমকে গিয়েছে বহু মানুষের গতে বাঁধা জীবন। অনেকক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে পুরনো পেশায় ভাতের জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষজন। ফলে বিকল্প রোজগারের সন্ধান করছেন অনেকই। কেউ কাপড়ের ব্যবসা বন্ধ করে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করছেন সবজি। কেউ আবার ফুচকার দোকান বন্ধ করে রাস্তায় বসে বিক্রি করছেন মাস্ক স্যানিটাইজার৷ গোটা দেশে বিগত ৩ মাসে এমনই চিত্র দেখা যাচ্ছে বারংবার। এতো গেল সাধারণ ব্যবসায়ীদের কথা, কিন্তু ভেবে দেখুন তো একজন শিক্ষক যিনি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা শিখিয়েছেন, তাকে যদি পেটের দায়ে সংসার চালাতে নিজের পেশাকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় আনাজ বিক্রি করতে হয় তাহলে কেমন লাগবে। দিল্লির নামী সরকারি স্কুলের প্রায় কয়েক হাজার অতিথি শিক্ষককে বর্তমানে বাধ্য হয়ে এভাবেই সংসার চালাতে হচ্ছে। অথচ এরা প্রত্যেকেই স্নাতকোত্তর, বিএড এবং সিটেট উত্তীর্ণ। ডিগ্রিতে আর পাঁচটা সরকারি শিক্ষকদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। অথচ দিনের পর দিন সরকারি পরীক্ষা দেওয়ার পরও এরা চাকরি পাননি৷ তাই অবশেষে অতিথি শিক্ষক হিসেবেই স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন প্রত্যেকে৷ আর এখন রাস্তায় রাস্তায় আনাজ বিক্রি করছেন ইংরেজির শিক্ষক। সাইকেলের সারানোর দোকানে কাজ করছেন বিজ্ঞানের শিক্ষক। আবার গম ক্ষেতে কাজের জন্য নিজের গ্রামে ফিরে গিয়েছেন সংস্কৃতের স্যার। এ ঘটনা চোখে জল আসার মতো।

তবে শুধু এই তিন জন শিক্ষকই নন গিত তিনমাস ধরে দিল্লির সরকারি স্কুলে এমন অসংখ্য অতিথি শিক্ষক এই মূহুর্তে এমন করুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। কবে স্কুল খুলবে, কিংবা এবছর আদৌ স্কুল খুলবে কিনা সেদিকে তা এই মূহুর্তে কেউই জানেনা। একপ্রকার বাধ্য হয়েই পেটের দায়ে পেশা বদলে বিকল্প আয়ের উপায় খুঁজছেন শিক্ষকরা। তবে এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের দায় থেকেই যাচ্ছে। কারণ ইতিমধ্যেই অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে বিভিন্ন স্কুলের। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সরকারের এতজন অতিথি শিক্ষককে যাতে টাকা না দিতে হয় সে কারণে মাত্র ২-৩ জন করে অতিথি শিক্ষককে ডাকা হচ্ছে। দিল্লিতে ১,০৩০ টি সরকারি স্কুলে অতিথি শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ২৫,০০০-এর বেশি। প্রতি বছর চুক্তিভিত্তিক তাদের নেওয়া হয়। মূলত দৈনিক ভিত্তিতে তাঁদের টাকা দেওয়া হয়। রবিবার, গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন বা কোনও জাতীয় ছুটির দিনে তাঁদের টাকা দেওয়া হয় না। সেই সময় অনেকে সামার ক্য়াম্পে যোগ দেন। কিন্তু লকডাউনের জেরে আয়ের সেইসব পথও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন হিসাব বলছে প্রত্যেকটি স্কুলে প্রায় ১০-১৫ জন করে অতিথি শিক্ষক রয়েছেন। তারা ক্লাসও করান আর পাঁচটা সরকারি শিক্ষকের মতই। কিন্তু মাসের শেষে দেখা যায় সরকারি ছুটি, রবিবার এগুলি বাদ দিয়ে তাদের বেতন মেরে কেটে মাত্র আড়াই থেকে তিন হাজার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই সামান্য টাকায় সংসার চালানো দায় হয়ে যায়। তার ওপর করোনা পরিস্থিতিতে গত তিনমাস বন্ধ স্কুল। সুতরাং সেই মাইনেটাও বন্ধ। শিক্ষা দফতরের উচিৎ ছিল অন্তত এই পরিস্থিতিতে সরকারি শিক্ষকদের পাশাপাশি স্কুল গুলি যেন অতিথি শিক্ষকদেরও বেতনের ব্যবস্থা করে সে বিষয়ে নজর রেখে নির্দেশিকা জারি করা।

যদিও গত ৫ মে দিল্লির শিক্ষা দফতরের তরফে রাজ্যের প্রত্যেকটি স্কুলে একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল। নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা ছিল, চলতি বছরের ৮ মে পর্যন্ত সব অতিথি শিক্ষকদের বেতন মিটিয়ে দিতে হবে। এমনকি যদি গরমের ছুটিতে তাদের ডাকা হয় সেক্ষেত্রেও তাদের আলাদা বেতন দিতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই অনেক স্কুলে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আলাদা বেতন দিতে হবে ভেবে স্কুলগুলির তরফে মাত্র ২-৩ জন করে অতিথি শিক্ষকদের ডাকা হচ্ছে। ওয়াজির সিং, দিল্লির সরকারি স্কুলের তিনিও একজন অতিথি শিক্ষক। গত ৮ মে পর্যন্ত সুলতানপুরীর একটি স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন তিনি। ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর, বিএড এবং সিটেট উত্তীর্ণ ওয়াজির এখন পেটের তাগিদে বাড়ির সামনে বসে আনাজ বিক্রি করছেন। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী, বাবা অসুস্থ, ফলে সংসারের হাল ধরতে শেষমেশ এত পড়াশুনো করে এই পথই বেছে নিতে হল। ওয়াজির বলেন, “দিনে ৪০০-৫০০ টাকা আয় হচ্ছে। আমার বাবার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। তিন ভাই পড়াশোনা করছে। স্কুল থেকে ডাক না পাওয়া পর্যন্ত আমি ফল-আনাজ বিক্রি করব। কিছু আয় তো হচ্ছে।”

একই অবস্থা বিজ্ঞানের শিক্ষক দেবেশ কুমারের। গত ৩১ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ হওয়ায় বেতন বন্ধ, ফলে প্রবল সংকটে পড়েছেন তিনি। এদিকে বাড়িতে তাঁর বয়স্ক মা, স্ত্রী এবং ছেলে রয়েছেন। ছেলে একটি বেসরকারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। তার ওপর ভাড়াবাড়িতে থাকায় প্রতিমাসে ভাড়ার টাকা গুনতে হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে গাজিয়াবাদে ভাড়াবাড়ির কাছে সাইকেল সারাইয়ের দোকানে কাজ করছেন দেবেশ। তিনি গত ছ’বছর ধরে দিল্লির সরকারি স্কুলে কর্মরত ছিলেন। আর এই লকডাউনে একধাক্কায় বিজ্ঞান শিক্ষক থেকে পেটের তাগিদে পেশা বদলে হয়েছেন সাইকেল মিস্ত্রী। দেবেশ বলেন, “এপ্রিল থেকে কাজ না থাকায় ছেলের স্কুলের টাকা মেটাতে পারিনি। খরচ সামাল দিতে সাইকেলের চাকা সারাই করছি।”

অন্যদিকে পশ্চিম দিল্লির একটি সরকারি স্কুলের সংস্কৃতের শিক্ষক সঞ্জীব কুমার। কিন্তু এপ্রিল থেকে তিনিও কর্মহীন। এই পরিস্থিতিতে হিমাচল প্রদেশে নিজের বাড়ি ফিরে যান তিনি। সেখানে নিজের গমের ক্ষেতে কাজ করছেন। তা দিয়েই কোনওভাবে সংসার টানছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতে স্নাতকোত্তর করা শিক্ষক।

এবিষয়ে দিল্লির শিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক জানান, “করোনা পরিস্থিতির জন্য এতজন অতিথি শিক্ষকের বেতন দিতে পারবে না সরকার। যখন প্রয়োজন হবে, তখন ডেকে নেওয়া হবে।” অতিথি শিক্ষকদের প্রতি সরকারের এই চূড়ান্ত গাফিলতি চোখে আঙুল দিয়ে কেন্দ্রের অব্যার্থতাকে ফুটিয়ে তুলেছে। তবে শুধু যে দিল্লিতেই এমন ঘটনা ঘটছে তা কিন্তু নয়। এই একই ঘটনার সাক্ষী পশ্চিমবঙ্গও। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে এরাজ্যে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ১০ হাজার পার্শ্ব শিক্ষক। তাদের কেউ বাংলার শিক্ষক, কেউ ইংরাজি পড়াতেন কেউ বা ভূগোল। এটাই ছিল তাদের পেশা কিন্তু লকডাউনে কাজ হারিয়ে চরম অর্থনৈতিক মন্দায় দিন কাটাচ্ছেন গোটা দেশের অতিথি শিক্ষকরা।

RELATED ARTICLES

Most Popular