নিজস্ব সংবাদদাতা: মকরামপুরে সৌভিক দোলুইয়ের লাশ পৌছালো সন্ধ্যে সাড়ে ৬টা নাগাদ। রাজ্য আর কেন্দ্রীয় পুলিশের ভিড়ে থিক থিক করছে মকরামপুর বাজার থেকে অভিরামপুর, সৌভিকের বাড়ি অবধি। ২৪ঘন্টা কেঁদে কেঁদে পরিবারের চোখের জল শুকিয়ে তখন আগুন ঝরছে। আর মকরামপুর? পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নারায়নগড় থানার এই ছোট্ট জনপদ গত আড়াই বছরে এই নিয়ে চার চারটি তরতাজা লাশ গুনেছে। ২০১৮ সালের ২৩শে আগষ্ট খোদ শাসকদলের দলীয় কার্যালয়ে বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন বিকাশ ভূইঁয়া, সুদীপ্ত ঘোষ,বিমল চৌধুরী। প্রত্যেকেই তৃনমূল কংগ্রেসের একনিষ্ঠ সক্রিয় কর্মী। এই তিন লাশের পেছনে শাসকদলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের অস্ত্বিত্ব মকরামপুরবাসীর কাছে এতটাই প্রকট ছিল যে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতেই পারেনি তৃনমূলের নেতারা। খোদ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি বলেছিলেন পার্টি অফিস মজুত রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে দুর্ঘটনা। পুলিশও সেই তত্ব খাড়া করেছিল কিন্তু মানতে রাজি হয়নি মকরামপুর। নিহতদের পরিবারই জানিয়েছিল ‘সুপ্রিম’ কারখানায় কার দখল থাকবে তাই নিয়ে দলের দুটি গোষ্ঠীর একটি গোষ্ঠী দলীয় কার্যালয়ে বোমা মজুত করেছিল।
এই ঘটনার পুলিশের তদন্তে অনাস্থা জানিয়ে যথাযথ তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় নিহতদের দুটি পরিবার। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এই মামলাকারীদের একজন দুর্গা চরণ পাত্র নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে তাঁর ঝুলন্ত দেহ মিলেছিল নিজের বাড়ি থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ভসরাঘাটে, সুবর্ণরেখা নদীর পাড়ে। আত্মহত্যা করার জন্য একজন ৭০ বছরের বৃদ্ধ যে ৪০কিলোমিটার যেতে পারে তাও দেখতে হয়েছে মকরামপুরকে। যদিও মামলা থেকে পিছু হটেনি পরিবার দুটি। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সুপ্রিয়া ঘোষ সামন্ত।
২০১৮ সালের পর ২০২১, মকরামপুরে রাজনীতির নতুন লাশের নাম সৌভিক দলুই। মাত্র ২৬বছরের সৌভিক যখন ৬বছরের তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। পরিবারের আরও তিন সন্তানের সঙ্গে সৌভিককে একাই বড় করে তুলেছিলেন তাঁর মা সুমিতা। পরোপকার করার নেশা থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল সৌভিক। দাদা বাইরে কাজ করে সংসারের চাপ সামলাতেন। দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে। এই পরোপকার করার জন্যই সৌভিককে বারবার হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে এমনটাই দাবি করেছেন সৌভিকের মা সুমিতা। তিনি জানিয়েছেন তীব্র গোষ্ঠী কোন্দল আর খুনের হুমকির জন্য ছেলেকে তিনি রাজনীতি থেকে সরিয়ে এনেছিলেন। ৬ মাস চুপচাপ বসেও গেছিল ছেলেটা কিন্তু কিছুদিন হল আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছিল সে।
প্রশ্ন উঠেছে কিসের হুমকি, কেন হুমকি? জবাব দিয়েছেন সৌভিকের দিদি আল্পনা দলুই। তাঁর কথায়, ‘ভাই চাইত বকেয়া সমস্ত সরকারি প্রকল্পের কাজ শেষ করে ফেলতে কিন্তু ওরা বলত আগে ভোট হোক, আবার আমরা ক্ষমতায় আসি। তারপর সব কাজ হবে। এই নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। রাস্তা ঘাট, বিদ্যুৎ, আবাস যোজনা, বার্ধক্য ভাতা ইত্যাদির কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিল ভাই।’ কিন্তু তার জন্য মারামারি খুনোখুনির কী হয়েছে? মকরামপুরের এক তৃনমূল কর্মী জানিয়েছেন, ‘ভোটের আগে এই সব কাজ করলে কাটমানি নেওয়া যাচ্ছিলনা। পাছে লোকে ক্ষেপে যায়। তাই কাজ গুলো ভোটের পর করার পরিকল্পনা ছিল দলের একাংশের। তাঁদেরই রোষানলে পড়েছিল সৌভিক।’
আল্পনা দলুই বলেছেন, ‘মঙ্গলবার ভাইকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় গোপন মিটিংয়ের নাম আছে বলে। তারপর সেই মিটিং শেষে মদের আসরে বসানো হয় আর সেখানেই গুলি করা হয়।’ কিসের গোপন মিটিং জানা যায়নি অবশ্য কিন্তু মিটিং একটা হয়েছিল যেখানে দুই গোষ্ঠীরই সব নেতা হাজির ছিলেন। ছোট বড় সব নেতা। গোষ্ঠী বলতে দুটিই। নারায়নগড় ব্লক সভাপতি মিহির চন্দ আর জেলা পরিষদ সদস্য সূর্যকান্ত অট্ট। অবিরাম যাঁদের মধ্যে কোন্দল লেগেই রয়েছে।
না, খুনের মোটিভ এখনও স্পষ্ট নয়। একদলের মতে মকরামপুর অঞ্চলের ক্ষমতায় ফিরে আসা লক্ষীকান্ত সিটের বদলার ফল এই ঘটনা কিন্তু ভোটের আগে যিনি সবে ক্ষমতা পেয়েছেন তিনি এটা করতে যাবেন কেন? অন্যদলের মতে লক্ষীকান্ত সিটের ওপর ঘটনার দায় চাপিয়ে ফের তাকে কোন ঠাসা করার জন্য সেমসাইড গোল খেলেছে ক্ষমতাচ্যুত নাকফুঁড়ি মুর্মু। মকরামপুর এসব জানতে চায়না, সেখানকার অধিবাসীরা শুধু মুক্তি চান এই রাজনীতির লাশ দেখা থেকে। সেই মহাভারতের গল্পের মত বক রাক্ষসের কাছে একটি করে যুবক ছেলে পাঠাতে পাঠাতে ক্লান্ত মকরামপুর। শুধু ক্লান্ত নয়, এখন চোখে মুখে ক্রোধের আগুন।
বুধবার সন্ধ্যায় সৌভিকের লাশ পৌঁছানোর সময় সেই আগুনের আঁচ পেয়েছিল শাসক। তাই স্থানীয় নেতা বা বড় নেতারা যেতে পারেনি মালা দিতে। সূর্যকান্ত অট্ট, মিহির চন্দ, বিধায়ক প্রদ্যোত ঘোষ, জেলা সভাপতি অজিত মাইতি কেউ যাননি। বিরবিরা থেকে বিমল ভূইঁয়া, রাধানগর থেকে সুভাস রায় চৌধুরী, নারায়নগড় থেকে সেক সেরিপ আর রানীসরাই থেকে জেলার এসটি সেলের দলীয় সভাপতি ভদ্র হেমব্রমকে দিয়ে মাল্যদান পর্ব সারতে হয়েছে। ভয়ে ভয়ে নিজের অনুগতর লাশে মালা দিয়েছেন নাক ফুঁড়ি মুর্মু।
পুলিশ আর প্যারা মিলিটারিতে ছেয়ে থাকা মকরামপুরকে না’হয় আপাততঃ সামলে নেওয়া গেল কিন্তু গোটা নারায়নগড় জুড়ে ইভিএম মেশিনে সেই ক্ষোভ আছড়ে পড়বেনা তো? শাসকের চিন্তা এখন সেটাই। কারন সৌভিকের চিতার ধোঁয়া ক্রোধ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা নারায়নগড় বিধানসভা এলাকা জুড়েই।