শশাঙ্ক প্রধান: শেষরক্ষা হলনা শেষ অবধি। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে টানা ৫০দিন লড়াই করে শুক্রবার কলকাতার একটি মহার্ঘ্য বেসরকারি হাসপাতালে প্রাণ হারালেন সুদীপ পাল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শেষ অবধি ছিনিয়ে নিল তাঁকে। মাত্র ১২বছরের ছেলেকে রেখে চলে গেলেন বালিচকের প্রিয় সন্তান। মৃত্যু কালে বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৪বছর। পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা থানার অন্তর্গত বালিচক স্টেশন সংলগ্ন ভোগপুর রবীন্দ্রপল্লীর বাসিন্দা সুদীপের মৃত্যুর খবর পেতেই শোকস্তব্ধ সমগ্র বালিচক এলাকা।
বালিচকবাসীর চোখের সামনে আপাদমস্তক বেড়ে ওঠা প্রাণচঞ্চল ছেলেটির মৃত্যু যেন মেনেই নিতে পারছেননা স্থানীয় বাসিন্দারা। মৃত্যুর খবরটাকেই দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে তাঁদের। মনে হচ্ছে , আজ কালের মধ্যেই যেন ফিরে আসার কথা ছিল তাঁর। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন সমগ্র বালিচক এলাকার সঙ্গেই যেন আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন সুদীপ। খবর পেলেই মানুষের আপদে বিপদে অনিমেষে ছুটে যেতেন। তাঁর প্রয়ানে আত্মীয় বিয়োগের যন্ত্রনায় কাতর বালিচকবাসী।
সুদীপের পড়াশুনা বালিচক ভজহরি ইনস্টিটিউশনে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর গ্র্যাজুয়েশন করেন পাঁশকুড়া মহাবিদ্যালয় থেকে আর এই সময় থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়া কান্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন। স্থানীয় বিবেকানন্দ ক্লাবের যেমন সদস্য ছিলেন তেমনই এলাকার অন্যান্য ক্লাব যেমন নেতাজী ক্লাব, বালিচক ইয়ংম্যান আ্যসোশিয়েশন ইত্যাদি ক্লাব সংগঠনের মধ্যে দিয়ে চলত সমাজসেবার কাজ। খেলাধুলাতেও উৎসাহী সুদীপ ভালো ক্রিকেট খেলতেন এবং পরবর্তী প্রজন্মকে উৎসাহিত করতেন।
বালিচক এলাকার বাসিন্দা সাহিত্যসেবী, গল্পকার দীপক জানা জানিয়েছেন, ‘অদ্যন্ত অরাজনৈতিক সুদীপের কাছে এলাকার সমস্ত মানুষই ছিল ভালোবাসার। খুবই আবেগ দীপ্ত, প্রাণবন্ত সুদীপ আমাদের সবারই প্রিয় মানুষ ছিল। খুবই সাধারণ হয়েও যে মানুষের ভালোবাসার এত কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায় তা সুদীপকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ওকে হারিয়ে বালিচকবাসী যেন নিজের সন্তানকে হারিয়েছে।” বালিচকের আরেক অধিবাসী মধুসূদন প্রধান জানিয়েছেন, “আমার সঙ্গে সুদীপের পরিবারের ১৮ বছরের সম্পর্ক। চোখের সামনে বেড়ে ওঠা ছেলেটা অসম্ভব বিনয়ী আর নম্রস্বভাবের। কোনও দিনই তাকে গলা উঁচু করে কথা বলতে শুনিনি। এই সময়কার প্রজন্মের ছেলেদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করত সে। বালিচকবাসীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল তার। আমি হতবাক হয়ে গেছি খবরটা পেয়ে। বিশ্বাসই করতে পারছিনা আমাদের সুদীপ নেই। কী ভাষায় শোক প্রকাশ করব খুঁজেই পাচ্ছিনা।”
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, সুদীপকে ফিরিয়ে আনার জন্য শেষ অবধি লড়াই চালিয়ে গেছেন তাঁরা। ৫০দিনে খরচ হয়েছে অন্ততঃ ২৫লক্ষ টাকা কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মরন ছোবল থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি তাঁকে। পেশাগত ভাবে ভারতীয় জীবন বিমার এজেন্ট সুদীপ নিজের ক্লাশ সিক্সে পড়া ছেলের জন্য ইদানিং মেদিনীপুর শহরেই থাকতেন। তাঁর একমাত্র সন্তান মেদিনীপুর রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে বলে সেখানেই থাকতে হত তাঁকে কিন্তু একদিনের জন্যও বালিকের সঙ্গে যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়নি।
সুদীপের মৃত্যু মর্মান্তিক খবর হিসাবে আছড়ে পড়েছে সাহিত্য জগতেও। তাঁর পিতা প্রফুল্ল পাল সাহিত্য জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। প্রফুল্ল পালের কবিতা মননশীল জগতের সম্পদ। তাঁর সম্পাদিত ‘প্রতিবেশী’ সাহিত্য পত্রিকাটি বহু নতুন প্রতিভাকে সামনে এনেছে। বিদ্যাসাগর সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের অবসর প্রাপ্ত এই মানুষটির পুত্র বিয়োগের ঘটনায় ব্যথিত সাহিত্য জগত। বাংলার পরিচিত কবি ব্যক্তিত্ব আশিস মিশ্র বলেছেন, “আমাদের সাহিত্য জগতের প্রিয়তম মানুষ প্রফুল্লদার পুত্র বিয়োগের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে গেছি। প্রফুল্লদা এবং সমগ্র পরিবারের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা। উনি দ্রুত এই শোক কাটিয়ে উঠুন এই কামনা করি।” নিজের স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান ছাড়াও সুদীপ রেখে গেছেন মা-বাবা, দাদা-বৌদি এবং ভ্রাতুষ্পুত্রকে। রেখে গেলেন শোকাতুর সমগ্র বালিচকবাসীকে।