সুবর্ণরৈখিক লোকভাষার ইতিহাস উপেন পাত্র
সুবর্ণরেখা নদী অববাহিকা অঞ্চলে তিনটি সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে– বঙ্গ সংস্কৃতি,উৎকল সংস্কৃতি ও খেরওয়াল সংস্কৃতি।উক্ত অঞ্চলটি অতীতকালে ওড়িশার অন্তর্ভুক্ত ছিল,তাই কিছু উৎকল প্রভাব আছে।ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে খেরওয়াল সমাজের সাঁওতাল ও মুণ্ডাভুমিজরা এখানে বসতি গড়ে তোলেন।
শ্রীজীব গোস্বামীর নির্দেশ মতো শ্যামানন্দ আচার্য উৎকলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম সংস্কারের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে সুবর্ণরেখা নদী তীরে সুরম্য গোপীবল্লভপুরে “শ্রীপাট” প্রতিষ্ঠা করেন। বহু বাংলাভাষী গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্ত এই অঞ্চলে এসে বসতি করায় এখানে ক্রমে বাংলাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠেন এবং ঐ কালে প্রচলিত আদি-মধ্য বাংলা এই অঞ্চলের সার্বজনীন ভাষা হয়ে ওঠে।হাটে-বাজারে ভাব বিনিময়ের ভাষা হওয়ায় এই ভাষাকে “হাটুয়া ভাষা” বা ‘মাঝিলা ভাষা” বলা হতো।
আদি-মধ্য বাংলা ভাষাতে একমাত্র লিখিত পুস্তক অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্য পাওয়া যায়।ডঃ সুধীর কুমার করন মহাশয় তাঁর গবেষণাপত্রে এই লোকভাষার সাথে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যভাষার সাদৃশ্যগুলি তুলে ধরেছেন।তাঁর মতে বাঁকুড়া জেলায় কাব্যটি পাওয়া গেলেও সুবর্ণরেখা নদী তীরস্থ লোকভাষার সাথে ঐ ভাষার বিস্তর সাদৃশ্য রয়েছে।
ডঃ করনের আগে বেলিয়াবেড়ার জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র প্রহরাজ মহাশয় এই লোকভাষাটিকে
“সুবর্ণরৈখিক লোকভাষা” নামে চিহ্নিত করে খাণ্ডারী ও পূবালী নামে দুটি বিভাষাতে বিভক্ত করেন।ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পূর্ব সিংভূম জেলার বহড়াগোড়া থেকে সাঁকরাইল থানার রোহিনী পর্যন্ত প্রচলিত বিভাষা খাণ্ডারী এবং রোহিনী থেকে দাঁতন পর্যন্ত বিভাষাটি পূবালী। দুই বিভাষার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো উত্তম পুরুষের একবচনে কর্তা ও তদনুযায়ী ক্রিয়াপদের পার্থক্য।উত্তম পুরুষের একবচনে খাণ্ডারীতে “মুঞি”(আদি-মধ্য বাংলা) এবং পূবালীতে ” আমি”(আধুনিক বাংলা) ব্যবহৃত হয়।উদাহরণস্বরূপ–
মান্য বাংলায়– আমি যাচ্ছি। (বর্তমান)
খাণ্ডারীতে– মুঞি যাওটঁ।
পূবালীতে– আমি যাইটি।
মা বা– আমি গিয়েছিলাম। (অতীত)
খা– মুঞি যাইথিনু।
পূ– আমি যাইথিলি।
মা বা– আমি যাবো। (ভবিষ্যত)
খা– মুঞি যামু।
পূ– আমি যাবা।
ডঃ করন খাণ্ডারী নামকরণ যথাযথ নয় বলে ঐ বিভাষাকে “গোপীবল্লভপুরী” নামকরণ করেন।কারণ গোপীবল্লভপুর শ্রীপাটকে কেন্দ্র করে ভাষা অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। তাঁর মতে অতীতের দুর্গমতার কারণে আদি-মধ্য বাংলা ভাষা এই অঞ্চলে জীবাশ্ম ভাষার মতো থেকে গেছে।
আলোচ্য লোকভাষায় বহু মৌখিক সাহিত্য আছে,যা পরবর্তী কালে কিছু কিছু লিখিত হয়, যথা– কয়েকটি লোকযাত্রা পালা,করম কাহানী, গাজন গান,যুগী গান,বৈশাখী পালের গান ইত্যাদি।লিখিত গ্রন্থের মধ্যে গোপীজনবল্লভ দাস রচিত “রসিকমঙ্গল” কাব্য বিখ্যাত।কাব্যটি দুষ্প্রাপ্য ছিল,বর্তমানে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। আধুনিক কালে কবি ভবতোষ শতপথী মহাশয় এই লোকভাষায় কাব্য রচনা করেন, তাঁর “আলকুশি” কাব্যগ্রন্থে আঠারোটি কবিতা ও আটটি ঝুমুর গান আছে।