জঙ্গল মহলের আর্যীকরণ উপেন পাত্র ব্যাপক অর্থে সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলা, ঝাড়খন্ড ও উত্তর পূর্ব ওড়িশাকে জঙ্গল মহল ধরে নেওয়া যায়।সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক কাল থেকে এখানে অস্ট্রিক খেরওয়াল সভ্যতার সূচনা হয়।উত্তর পশ্চিমের তথাকথিত আর্য, পূর্বের বঙ্গ ও দক্ষিণের দ্রাবিড় সভ্যতার সাথে এই সভ্যতার বেশ স্বাতন্ত্র আছে।
বঙ্গ সহ আর্যাবর্ত্যে ও দাক্ষিণাত্যে আর্যীকরণ বা ব্রাহ্মণ্যায়ণ যতটা, এখানে ততটা সহজ হয়নি।শেষাবধি জঙ্গল মহলের আর্যীকরণ হলেও ব্রাহ্মণ্যবাদকে এখানে বিস্তর সমঝোতা করে চলতে হয়েছে।
প্রবাদে আছে– “রাম মরেছে বেগুনে”। রাম অর্থে বড়কে বোঝায়,যথা রামদা,রামছাগল ইত্যাদি। কিন্তু রামবেগুনের আকার খুব ছোট। ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতীক রাম ও কৃষ্ণ জঙ্গল মহলে ততটা পাত্তা পাননি।।
বৈদিক সভ্যতার যজ্ঞ ক্রিয়াদি অন্তে পূজা সংস্কৃতির পত্তন হয়।পূজা পদ্ধতিতে অনার্য সভ্যতার প্রভাব আছে,বিশেষত জঙ্গল মহলের অস্ট্রিক সভ্যতার প্রভাব বেশী। অনার্য পূজা উপকরণ পান,সুপারি,ধান,দুব্বা,সিঁদুর ও হরিতকী ব্রাহ্মণ্য ধর্মে গৃহীত হয়েছে।পূজার কালে অনার্য পুরোহিত ( লায়া,দেহুরী,পড়িত)এর কাঁধে লম্বমান শনের গুচ্ছ থেকে পৈতার উদ্ভব কিনা,তাও গবেষণার বিষয়।
বেদ ছান্দস পরবর্তী মাগধী প্রাকৃত ভাষা এই অঞ্চলে গৃহীত হলেও পারস্পরিক মিথঃক্রিয়ার ফলে বহু অস্ট্রিক শব্দের সংস্কৃতায়ন করা হয়েছে। মাগধী অবহট্ট জাত মানভূমী,সাদরি ও খাণ্ডারী এই অঞ্চলের লোকভাষাতে পরিণত হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মতো বৌদ্ধ ও জৈনরাও জঙ্গল মহলের পৃথক সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
মগধে মৌর্য শাসন অন্তে জঙ্গল মহলে আর্যীকরণ প্রয়াস শুরু হয়।এই অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না,কিন্তু পরস্পরের মধ্যে একটি ” মিতান” বা মিত্রতা সম্পর্ক ছিল,একটি সুস্থিত বিনিময় প্রথা ছিল।সামাজিক স্বায়ত্ব শাসন ছিল।এই অঞ্চলের অধিপতিরাও প্রকৃত অর্থে রাজা জমিদার ছিলেন না,তাদের সাধারণ জনের মতোই জীবনযাত্রা ছিল, লোকায়ত পরবে সাধারণের সাথে মিশে নৃত্যগীতে অংশ নিতেন।সামাজিক বিচার ব্যবস্থা গোষ্ঠীপতিদের হাতে ছিল,ভূস্বামী তাতে নাক গলাতেন না।
মৌর্য-ব্রাহ্মণ্য কাল,সুলতানি-বাদশাহী কাল কোন কালেই এই সুস্থিত সমাজ ব্যবস্থার খুব বেশী প্রভাবিত হয়নি।
কর্ণওয়ালিশের “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” এর ফলে এই সুস্থিতি প্রবল অস্তিত্ব সংকটে পড়ে।যার ফলশ্রুতিতে মুণ্ডা বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদোহ ও চুয়াড় বিদ্রোহ হয়।
আদি অস্ট্রিক যুগে এই অঞ্চলে তামা উৎপাদন শুরু হয়।তামাজুড়ি থেকে তাম্রলিপ্ত বন্দর হয়ে ঐ তামা সিন্ধু সভ্যতার লোথাল বন্দরে যেতো কিনা, তা গবেষণার বিষয়।
কালের প্রবাহে বৈদিক দেবতা সমূহ বিলীন হয়ে পৌরাণিক দেবতার উদ্ভব ঘটে,জঙ্গল মহলে তারা ঠাঁই পাননি।বরঞ্চ প্রকৃতি পূজক অনার্যদের সাথে মিথঃক্রিয়ায় নানা লৌকিক দেবতার জন্ম হয়। দুর্গা,কালী,লক্ষ্মী,সরস্বতী ইত্যাদি দেবী; শিব, গণেশ,বিশ্বকর্মা ইত্যাদি দেবতাও জঙ্গল মহলে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।জামাই ষষ্ঠী প্রথাও তাই।
এই অঞ্চলের সমস্ত পরব ছিল কৃষি নির্ভর।পয়লা মাঘকে কৃষিবর্ষের সূচনা ধরা হতো।মাঘ ও ফাগুন মাস জুড়ে হতো “গড়াম” বা গ্রামদেবতার পূজা,পরে তার সাথে লৌকিক দেবী শীতলা যুক্ত হয়।চৈত্র,বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাস জুড়ে হতো “ধরম” পূজা।ধরম-কামিনা একত্রে পূজিত হতো। পরে বৌদ্ধ প্রভাবে তা “ধর্মঠাকুর” হয়।ব্রাহ্মণ্যায়ণের ফলে ধর্ম-কামিনা শিব-পার্বতীতে পরিনত হন।
লোকাচারে তেরোই জৈষ্ঠ্যকে জলদাগমের সূচনা মনে করা হতো।ঐ মাসের সংক্রান্তিতে ভূমি পূজা (ব্রাহ্মণ্যায়ণে ধরিত্রী মাতা)হতো। ভূমি মাতাকে ঋতুমতী ও শস্যবতী হবার আবাহন জানানো হতো। আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহকে ধরিত্রী মাতার ঋতুকাল মান্য করে কৃষি কাজ বন্ধ রাখা হতো।
লোকাচারে ধানকে ধরিত্রী কন্যা মনে করে ধান্যকন্যার বিবাহ ও সাধভক্ষণ করা হতো।রাখী পূর্ণিমা বা গমাতে হতো বিবাহ এবং আশ্বিন বা ডাক সংক্রান্তিতে হতো সাধভক্ষণ।
মধ্যবর্তী কালের পরব ছিল ইঁদ,করম ও মনসা ঝাঁপান (প্রাচীন মনসাম্মা থেকে মনসার উদ্ভব হতে পারে)।ব্রাহ্মণ্যায়ণ কালে ইঁদকে “ইন্দ্রাভিষেক” করা হয়।করম-জাওয়া ছিল বৃক্ষ পূজা ও শস্য পূজা।ডাক সংক্রান্তির পরে হতো কৃষি বাহন গো মহিষের পুজো,যা বর্তমানে “বাঁদনা” নামে প্রচলিত আছে।ঐ কালে পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচারণ করে অগ্ন্যুৎসব করা হতো।
পরবর্তীকালে আরও দুই লৌকিক দেবীর (ঘরোয়া দেবীও বলা যায়)ভাদু ও টুসু পূজা শুরু হয়।ভাদ্র মাস জুড়ে ভাদু ও পৌষ মাস জুড়ে টুসু পরব পালিত হয়।কৃষিবর্ষের শেষে মকর পরবে কৃষি যন্ত্রাদি ও খামার পুজো করা হয়।
এইভাবে জঙ্গল মহলের কৃষিভিত্তিক বারোমাস্যা শেষ হতো।