নিজস্ব সংবাদদাতা: ‘২৭ঘন্টার ট্রেন সফরে ভারতীয় রেলের দৌলতেই এবার আশংকা হচ্ছে করোনা নিয়েই বাড়ি ফিরছি ঘরে। বাড়ির লোকগুলোও না আমার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ে।’ খড়গপুরের হিজলী স্টেশনে নামার পর শ্রমিক স্পেশাল এক্সপ্রেস সম্পর্কে এমনই অভিজ্ঞতা ‘দ্য খড়গপুর পোষ্ট’কে শেয়ার করলেন বাঁকুড়ার খাতড়া থানার বাসিন্দা গুরুসদয় রায়। বুধবার বেলা ৩টা নাগাদ হিজলী স্টেশনে তামিলনাড়ুর কাটপাটি স্টেশন থেকে ২৭ঘন্টার সফর শেষে হিজলীতে নেমেছেন গুরুসদয়, যেমনটা নেমেছেন আরও ১৫২১ জন যাত্রী। স্টেশন চত্বরে নেমেই নেতা মন্ত্রী আমলাদের সম্বর্ধনার ধাক্কা সামলে স্টেশনের বাইরে নেমেই সাংবাদিক দেখেই ডান হাতের কড়ে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ”দাদা আসে পাশে ইয়ে করার জায়গা আছে?”
বললাম, কেন ট্রেনে করেননি?
বলছি, দাদা বলছি। আগে জায়গাটা?
ইশারা করতেই পায়ের কাছে লাগেজ দুটো নামিয়ে ‘দাদা একটু দেখবেন ‘ বলেই বছর সাতচল্লিশের মানুষটা প্যান্টের চেন খুলতে খুলতেই দৌড়ালেন হিজলী আর.পি.এফ ব্যারাকের দিকে। তারই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাস গুলোর মাঝে হারিয়ে গেলেন মিনিট পাঁচেক। তারপর প্যান্টের চেইন লাগাতে লাগাতে এগিয়ে এসে বললেন, ‘১০ ঘন্টা পেচ্ছাপ করিনি দাদা। সকাল ৬টায় শেষবার বাথরুমে ঢুকেছিলাম। কামরায় একটাই বাথরুম, তারমধ্যেই সবাই যাওয়া আসা করছে। জল নেই বললেই চলে, চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। গোটা ট্রেনটাই যেন একটা নরক।’ একটু ধাসস্ত হয়ে বসলেন।
শুরু হল ইন্টারভিউ। গুরুসদয় জানালেন, “ভেলোরের একটা হোটেলে কাজ করি। বাড়িতে কিছুদিন ছুটি কাটানোর পর ২০ ফেব্রুয়ারি ফের কাজে যোগ দিলাম। লকডাউন শুরু হয়ে গেল। দিন পাঁচেক হোটেলের মালিকই খাবার দিচ্ছিল কিন্তু তারপর বন্ধ করে দিল। এরপর সরকার মানে স্থানীয় প্রশাসনই দিচ্ছিল। খুব খারাপ নয়। তিন বেলা খাবার ছিল। দুবেলাই ভাত, সবজি, সম্বর ডাল। কিন্তু কাজ কামাই নেই, সংসার চালানোর পয়সা নেই বাধ্য হয়ে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নি। সরকারের কাছে আবেদন করি বাড়ি ফেরার।”
একটু দম নিয়ে গুরুসদয় জানালেন, ” ৯তারিখ তামিলনাড়ুর সরকার পাশ দিয়ে গেল। বলল, সব কিছু গুছিয়ে রাখতে। ১২ তারিখ ওদের বাস এসে নিয়ে যাবে কাটপাটি স্টেশনে। মঙ্গলবার বাস এল, চড়লাম। ভালই ব্যবস্থা। একটা বাসে ২০ জন। বাসে ওঠার আগে আর স্টেশন চত্বরে দুবার থার্মাল স্ক্রিনিং হল। একটা ট্রেনের টিকিট দেওয়া হল। কিন্তু ট্রেনে উঠেই অবস্থা খারাপ। কোনও বার্থ নম্বর নেই। ভিড়ে ঠাসা। কোনও রকমে একটা জায়গা নিয়ে বসলাম। অনেকেই দেখলাম মাস্কের বালাই নেই। একটাই বাথরুম, লোক ঢুকছে, বেরুচ্ছে।সারা ট্রেন সেই জলভেজা জুতো ঘুরছে। এখানে ওখানে সর্বত্র মানুষের হাত পড়ছে। জল নেই ঠিকমত, বাথরুম নোংরা হয়ে আছে। মনে হচ্ছে গোটা ট্রেনেই করোনা ছড়িয়ে আছে।”
ফের একটু দম নিলেন তিনি। তারপর বললেন, “বলা হয়েছিল ট্রেনে খাবার দেওয়া হবে। খাবার বলতে শুধুই শুকনো পাউরুটি। চার বেলাই পাউরুটি মাঝে শুধু একটা কেক। আমাদের সবারই থার্মাল স্ক্রিনিং হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেটাতো আর করোনা টেস্ট নয়। যদি ভেতরে ভেতরে কারও করোনা থেকে থাকে তাহলে ওই কামরাতে যারা ছিল তাঁদের প্রত্যেকেরই করোনা হয়ে যাবে। আমি সেই ভয়টাই করছি। বাড়িতে কাচ্চা বাচ্চা রয়েছে। এখন মনে হচ্ছে বরং থেকে গেলেই ভাল হত।” আশংকা নিয়েই বাসে উঠে গেলেন গুরুসদয়।