নিজস্ব সংবাদদাতা: কোথায় একবিংশ শতাব্দী আর কোথায় সচেতনতা! সাপে কামড়েছে জানার পর যে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে প্রাণে বেঁচেও যেতে পারত তাকে সাড়ে তিনঘন্টা ফেলে রাখা হল ওঝার কাছে। চলল ঝাড়ফুঁক। তারপর ওঝা হাত তুলে দিলে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে, চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু চিকিৎসকদের কিছুই করার ছিলনা কারন হাসপাতালে আসার আগে মারা গিয়েছিল ওই কিশোরী। এরপরও মেয়ে ভেলায় ভাসিয়ে দিলে বেঁচে আসতে পারে মনে করে তাই ভাসিয়ে দেওয়া হল নদীতে। ঘটনা অন্য কোথাকার নয়, এই বাংলার।
এইমর্মান্তিক এবং চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে সুন্দরবন সংলগ্ন গোসাবায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে ১০ বছরের ওই মৃতা কিশোরীর নাম পূজা মৃধা। গোসাবা ব্লকের ছোট মোল্লাখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫ নম্বর কালিদাসপুর গ্রামের বাসিন্দা এই নাবালিকা বাবার নাম দীপ মৃধা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, শুক্রবার রাতে বাবার সঙ্গেই ঘুমিয়েছিল পূজা। রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ তাকে সাপে কামড়ায়। ঘটনা জানতে পারার পরই দীপ মেয়েকে নিয়ে যান স্থানীয় এক ওঝার কাছে। সেখানে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে চলে ঝাড়ফুঁক-তুকতাক। কিন্তু অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি বরং ক্রমশ নেতিয়ে পড়তে থাকে মেয়ে। শেষে অবস্থা বেগতিক দেখে হাল ছেড়ে দেয় ওঝা। দীপ তখন মেয়েকে নিয়ে ছোটেন স্থানীয় ছোট মোল্লাখালি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা শুরুর আগেই মৃত্যু হয় ওই বালিকার।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ঠিক সময় যদি মেয়েটিকে হাসপাতালে আনা যেত তাহলে তাকে বাঁচানো যেত। যদিও তারপরেও কুসংস্কারের বেড়া থেকে বের হতে পারেননি দীপ। মারা যাওয়ার পরও মেয়ে বেঁচে ফিরে আসতে পারে এই আশায় এবার মৃত মেয়ের দেহ মান্দাস বা কলার ভেলায় চাপিয়ে স্থানীয় সারসা নদীতে ভাসিয়ে দেন দীপ ও পরিবারের অন্যান্যরা। শনিবার সকালে ঘটনার খবর প্রকাশ্যে আসতেই নিন্দার ঝড় ওঠে। সাপ কামড়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সমরেন্দ্রনাথ রায় এই ঘটনার তীব্র ধিক্কার জানিয়ে প্রশাসনকে যথাযথ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। এরপরই গোসাবা থানার পুলিশ সারসা নদী থেকে পূজার দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায়। তার মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত ওঝার খোঁজ শুরু করেছে পুলিশ। পরিবারের লোকেদেরও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে।
গোটা ঘটনা খতিয়ে দেখে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে বলে জানিয়েছেন গোসাবা থানার পুলিশ আধিকারিক।
চিকিৎসক ও সর্প বিশারদরা জানিয়েছেন, ” এমন কোনও ভারতে এমন কোনও সাপ নেই যার দংশনের পর সময়মত হাসপাতালে নিয়ে গেলে এবং আ্যন্টিভেরম দেওয়া হলে দংশিত ব্যক্তিকে বাঁচানো যায়না। তাঁদের মতে সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের (৩ঘন্টা ১০মিনিট )মধ্যে ১০০ মিলিলিটার এএসভি বা আ্যন্টিভেরম
শরীরে প্রবেশ করালে রোগী বেঁচে যাবে৷ পশ্চিমবাংলার প্রায় সমস্ত সরকারি হাসপাতালে এই এএসভি থাকে। সুন্দরবন এলাকায় সাপের কামড়ের ঘটনা বেশি হয় বলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে তো থাকেই না থাকলেও ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বা গ্রামীন হাসপাতালে থাকেই এবং এই অঞ্চলের চিকিৎসক ও নার্সরা খুবই অভিজ্ঞ হন সর্পদংশিত রোগীর চিকিৎসায়। সব মিলিয়ে শুধুমাত্র কুসংস্কারের বশবর্তী হওয়ার কারণেই মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে।
সর্প বিশারদরা আরও জানিয়েছেন ভারতে প্রায় আড়াইশো প্রজাতির সাপ আছে, তার মধ্যে ৫২টি প্রজাতি বিষধর৷ এর মধ্যে ৪০টিরও বেশি প্রজাতির সাপ সামুদ্রিক৷ অর্থাৎ স্থলভাগের ১০ থেকে ১২টি প্রজাতি বিষধর। এরমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ছটি বিষধর প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়৷ যার মধ্যে চারটি সাপের কামড়েই বেশি মৃত্যু হয়৷ এই চারটি সাপ হল গোখরো যাকে কেউ বলে খরিস, কেউটে স্থানীয় ভাবে আলকেউটে, কালকেউটে, শামুকভাঙা, চন্দ্রবোড়া বা বড়া, কালাচ। যেহেতু বেশিরভাগ সাপই বিষহীন তাই সেসব ক্ষেত্রে রোগী এমনই ভালো হয়ে যায়। অনেক সময় বিষধর সাপ কামড়ালেও বিষ ঢালতে পারেনা। এসব ক্ষেত্রেই কেরামতি দেখায় ওঝারা। কিন্তু যখন বিষধর সাপ কামড়ায় আর পর্যাপ্ত বিষ রক্তে পৌঁছে দিতে পারে তখন ওঝার ক্ষমতা নেই তাকে বাঁচানোর। একমাত্র চিকিৎসকই পারেন তাকে বাঁচাতে।