কলকাতা ব্যুরো: আবারও গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক এড়িয়ে গেলেন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। মূখ্যমন্ত্রী মমতার ব্যানার্জী তৈরি করে দেওয়া ৭ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি আর ২১সদস্যের কো অর্ডিনেশন কমিটির বৈঠক বলা যেতে পারে, জাস্ট উপেক্ষা করলেন পরিবেশ তথা পরিবহন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। অবশ্য এটাই প্রথম নয়, ভোট কুশলী প্রশান্ত কুমার যবে থেকে অভিষেক ব্যানার্জীকে তৃনমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জীর পদে অভিষিক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তবে থেকেই একের পর এক বৈঠকে গর হাজির থেকেছেন শুভেন্দু, এবারও তার ব্যতিক্রম হলনা। সে দলীয় কিংবা সরকারি যে বৈঠকই হোক না কেন!
২১ শে জুলাইয়ের পর ২৩শে জুলাই, মমতা ব্যানার্জী রদবদল করেছেন রাজ্য ও জেলার বিভিন্ন স্তরের কমিটি গুলির। দলের পাশাপাশি রদবদল হয়েছে গন সংগঠন গুলির। প্রতিটি রদবদলেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অভিষেক অনুগামীদের আধিপত্য। প্রশান্ত কুমার বা পিকে এতদিন ভেতরে ভেতরে যে পরিকল্পনা করেছেন তার বহিরঙ্গের রূপটি প্রকট হয়েছে এই রদবদলে। এড়ানো যায়নি শুভেন্দুকে তাই শীর্ষ পদে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে তাঁকে কিন্তু শেকড় কেটে ফেলা হয়েছে নিচু তলায়। এই রদবদলে জেলা পর্যবেক্ষকের পদ অবলুপ্ত করে শুভেন্দুর সাত সাতটি জেলা সংযোগ ছিন্ন করা হয়েছে। আর জেলা গুলিতে থাকা শুভেন্দু অনুগামীদেরও ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে বলে অভিযোগ। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে স্টিয়ারিং কমিটি তথা কোঅর্ডিনেশন কমিটির প্রথম বৈঠক বয়কট কী কমিটির অস্তিত্বকেই অস্বীকার? প্রশ্ন উঠছে।
তৃনমূলের একটি অংশ বলছেন, শুধু শুভেন্দু নন, কো-অর্ডিনেশন কমিটির ২১ সদস্যের মধ্যে মোট ৪ জন গরহাজির ছিলেন এ দিনের বৈঠকে। তাঁদের মধ্যে একজন কোয়রান্টিনে থাকার কারণে বৈঠকে যোগ দিতে পারেননি বলে পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান। তবে রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী তথা তৃণমূলের নবগঠিত স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শুভেন্দুর অনুপস্থিতির কারণ খুব স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করা হয়নি দলের তরফে। এঁদের মতে শুভেন্দুর এই হাজির না হওয়ার মধ্যে অযথা গুরুত্ব খুঁজে বেড়ানোর কোনও অর্থ নেই। সে হয়ত নেই কিন্তু তৃনমূল কংগ্রেস বা প্রশান্ত কুমারের দলবল কী সত্যিই এর পেছনে কোনও গুরুত্ব খুঁজে পাচ্ছেননা নাকি গুরুত্ব খুঁজতে চাইছেন না সেটাও ভাবতে হবে বৈকি। কারন এটা তো প্রথম নয় যে শুভেন্দু কোনও বৈঠক এড়িয়ে গেলেন!
পি.কের ভোট মার্কেটিং প্রক্রিয়ার প্রথম প্যাকেজ ‘দিদি কে বল’ যেদিন রিলিজ করে সেদিনই শুভেন্দু বুঝতে পেরেছিলেন তৃণমূলের রাজনৈতিক যাত্রা পথে মমতা ব্যানার্জীর এক এবং অদ্বিতীয় উত্তরসূরি হিসাবে তাঁর প্রতিষ্ঠার পথে কাঁটা বেছানো শুরু হয়ে গেছে। সেদিন মঞ্চে জায়গা দেওয়া হয়নি তাঁকে। তার জবাবও পেয়েছিল দল। ‘দিদি কে বল’ কর্মসূচি কার্যত বয়কট করেছেন শুভেন্দু। ঘনিষ্ঠদের বলেছেন, ‘মমতা ব্যানার্জী নিজেই এমন একটা ব্যান্ড যে তার জন্য কর্পোরেট প্যাকেজের প্রয়োজন হয়না।’ এরপরই লোক সভায় ১৮টা উইকেট হারানোর পর পি.কের দ্বিতীয় দফার মার্কেটিং ধামাকা ‘বাংলার গর্ব মমতা’ উপস্থিত থাকেননি শুভেন্দু অধিকারী।
এরপরই কোভিড ও আমফান পর্ব। আমফানে বিপর্যস্ত বাংলা। সেচ দপ্তরের দায়িত্বে থাকা শুভেন্দু অধিকারী কলকাতার কন্ট্রোল রুমে না বসে হাজির দিঘায়। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেই দিঘায় আর কন্ট্রোলরুম কাঁথির শান্তি কুঞ্জে। দুদিন পরেই আমফান পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মূখ্যমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। হাজির ফিরাদ হাকিম সহ গুরুত্বপূর্ণরা। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলছেন, ‘শুভেন্দুকেও ডেকেছিলাম, আসতে পারেনি হয়ত।’
এরপর হুলদিবস উপলক্ষ্যে রাজ্যের মূল অনুষ্ঠান ঝাড়গ্রামে। পার্থ চ্যাটার্জির সাথেই বড়বড় করে নাম ছাপা হয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীর। অনুষ্ঠান হয়েছে, পার্থ হাজির হয়েছেন, শুভেন্দুও সেই ঝাড় গ্রামেই গেলেন কিন্তু সরকারি অনুষ্ঠান নয়, হাজির হলেন কাঁটাপাহাড়ির বেসরকারি অনুষ্ঠানে।
এই একের পর এক সরকারি কিংবা দলীয় বৈঠক, কর্মসূচি বয়কটের মধ্যে তৃণমূলের বর্তমান কার্যকরী নেতৃত্ব বা সোজা ভাষায় বললে অভিষেক ও পি কে বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ কিছু না খোঁজার জন্য সংবাদ মাধ্যমকে পরামর্শ না দিতেই পারেন কিন্তু তাতে যে শুভেন্দু অধিকারীর গুরুত্ব এখনো কমে যাচ্ছেনা সেটা আর কেউ না বুঝুক মমতা ব্যানার্জী ভালই বুঝতে পারছেন আর পারছেন বলেই তৃণমূলের এই নব্য বাহিনীর বালখিল্যতায় আর যাইহোক তৃনমূল স্তরে সংগঠন টিকবেনা। আর তিনি সেটা বুঝতে পারেন বলেই এখনও জঙ্গল মহল থেকে শুরু করে মালদা মুর্শিদাবাদের জন্য শুভেন্দুই তাঁর কাছে ভরসা হয়ে দাঁড়ান। দিলীপ ঘোষের হাত থেকে খড়গপুর উদ্ধারে শুভেন্দুরই ডাক পড়ে। কিন্তু ‘খাল পের হলেই কুমীর শালা’ র মতই মমতা ব্যানার্জীর ডাকে যতবারই শুভেন্দু ক্রাইসিস ম্যানেজ করেছেন ততবারই অভিষেকের নেতৃত্বে ক্রাইসিস ম্যানেজের পর শুভেন্দুকে ফের প্রান্তিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
অভিষেক সাংসদ হওয়ার পর তাঁকে দিল্লিতে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য শুভেন্দুকে ‘মন্ত্রী’ বানিয়ে রাজ্যে আটকে দেওয়া আর পরবর্তী কালে রাজ্যের সমস্ত জায়গা থেকে ছেঁটে স্টিয়ারিং কমিটিতে আটকে দেওয়ার কৌশল শুভেন্দু অধিকারী বুঝবেন না এমনটা হয়? স্বাভাবিক কারনেই তিনিও একের পর এক বৈঠকে গর হাজির থাকছেন।
তৃণমূল সরকার গঠনের পেছনে মূল তিনটি ভিত্তি হল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আর লালগড় আন্দোলন। এরমধ্যে সিঙ্গুর তৃনমূলকে কলকাতা ভিত্তিক সমর্থন জুগিয়েছে ঠিকই কিন্তু সরকার গঠনের প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সংখ্যক আসন এনে দিয়েছে নন্দীগ্রাম আর লালগড় আন্দোলন । আর এই দুটি আন্দোলনের ফসল তৃণমূলের ঘরে তুলে দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। কী ভাবে তিনি তা করেছেন সেটা আলাদা প্রশ্ন কিন্তু করেছেন। সত্য এটাই যে শুভেন্দু ছাড়া ২০১১ শুধু মমতা ব্যানার্জীর হাত ধরে আসেনি। আবার সত্য এটাও যে এই তিন আন্দোলনের কোথাও অভিষেক ব্যানার্জীর কানাকড়ি অবদান নেই। সেই শুভেন্দুকে যদি অভিষেকের নেতৃত্ব, পিকের নেতৃত্ব মানতে বলা হয় তিনি মানবেন কেন? তাই তিনি স্পষ্ট করেই মমতা ব্যানার্জীকে বলতে পারেন, ‘আপনার নেতৃত্ব ছাড়া আর কারও নেতৃত্বে কাজ করতে পারবনা।’
২০১১ র পর ২০২১। তৃনমূল আর সেই তৃনমূল নেই। তৃনমূল বিরোধী নয়, শাসক দলে। মমতা ব্যানার্জীর বয়স হয়েছে, সক্ষমতা কমছে। ২০১৯ য়ের লোকসভায় বিধানসভা ক্ষেত্র অনুযায়ী কার্যত ভরাডুবি। কাটমানি আর আমফান ক্ষতিপূরণের পাহাড় প্রমান দুর্নীতি। এসব নিয়েই ২০২১। দিন যত গড়াবে আরও সমস্যা বাড়বে সেই সমস্যার পাহাড় ভাঙবে শুভেন্দুকে ছাড়া এমন ভাবনা যারা ভাবছেন তাঁরা নিশ্চিত ভাবেই আজ মূর্খের স্বর্গে। আর তারাই বলছেন বৈঠকে শুভেন্দুর গরহাজির হওয়াটাকে গুরুত্ব না দিতে। হয়ত তারাই ফল বেরুনোর পর বলবেন, তৃণমূলের হেরে যাওয়াটাকে গুরুত্ব না দিতে কারন তখন তাঁদেরই হয়ত অন্য দলে চলে যাওয়ার সময় হবে।