ওড়িশা ভ্ৰমণ (৭+৮ পর্ব) মীর হাকিমুল আলিনন্দনকানন জাতীয় উদ্যান
দিনটা ছিল 3 জানুয়ারি 2018, আমরা পুরী ও ওড়িশার অন্যান্য জায়গা ঘোরার পর নন্দনকান জাতীয় উদ্যান যাবো ঠিক করেছি l পরিকল্পনা মতো আমরা সকাল 8 টা নাগাদ পুরী থেকে একটা লোকাল ট্রেন ধরি l প্রায় 2 ঘন্টা পর নামলাম একটা ছোটখাটো স্টেশন ‘বারং ‘এ l ওখান থেকে কিছুটা দূরেই এই জাতীয় উদ্যানটি অবস্থিত l স্টেশনে আমরা অটো ধরলাম l 5 মিনিটেই পৌঁছে গেলাম একেবারে উদ্যানের গেটের সামনে l চারদিকে বেশ দোকান পাট l খুব খিদে পেয়েছে তাই ওখানে ইডলি জাতীয় এক ধরনের খাবার খেলাম l দিয়ে টিকিট কাটলাম 40 টাকা প্রতি জন l ভেতরে ঢুকেই দেখি সামনে এক বিরাট ফোয়ারা l আর তার চারদিকে সবাই বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গি করে সেলফি তুলছে, ছবি তুলছে l আমরাও তার ব্যতিক্রম রইলাম না l
উদ্যানের ভেতরে গাড়ি ভাড়া করে বিভিন্ন সাফারি তে যাওয়া যায় l কিন্তু আমরা পায়ে হেঁটেই ঘুরবো ঠিক করলাম l কোনদিকে কি আছে তার মানচিত্র নকশা দেখে হাঁটা দিলাম l প্রথমেই কতগুলো বাঁদরের সাথে দেখা l বসে বসে বিস্কুট খাচ্ছে l আমরা যেতেই ছুটে এসে এমন আবদার করতে লাগলো কি বলবো l বলতে চাইছে কিছু যেন ওদের খেতে দিই l কিন্তু খাবার নিয়ে ঢোকা যায়না l তাই আমাদের ব্যাগে কিছুই খাবার ছিল না l তাদেরকে কোনোক্রমে সামলে এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা পুকুরের পাড়ে বসে আছে কতগুলো ভাল্লুক l কালো কালো বড় বড় l
ওখানেই আমি সঙ্গীহীন হয়ে পড়ি l আমার সঙ্গী সাথী দের ফোন করেও আর খুজে পাইনি l তারা অন্যদিকে চলে গেছে l নিরুপায় হয়ে একা একা ঘুরতে লাগলাম l আরো অনেকে যাচ্ছে তাদের পিছু পিছু আমিও চললাম, দেখলাম একটা বাঘ শুয়ে আছে একটা মাচার ওপর l ঘুমোচ্ছে, বাইরের এতো চিৎকার চেঁচামেচিতেও তার ঘুম ভাঙছে না l আরো এগোলাম একটা সিংহ শুধু পায়চারি করছে দেখলাম lওটা জন্মেছে 23 জুলাই 2015 সালে l ওর মা এর নাম রাধা l
কিছুটা যেতেই দেখি আবার এক বাঘ l সেও একই ভাবে পায়চারি করে যাচ্ছে মন দিয়ে l কে কি করছে, বলছে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তার l এবার দেখলাম কত গুলো নেকড়ে বাঘ জল খাচ্ছে l দেখতে শেয়ালের মতো l দেখলাম আর এক সিংহ কে, এর আবার এই বড়ো বড়ো কেশর l
হেঁটেই চলেছি অধীর আগ্রহে এবার কি আছে এবার কি আছে? এবার দেখলাম সাদা বাঘ l এই জাতীয় উদ্যানে সব থেকে বেশি সাদা বাঘ আছে l
দেখলাম দুটি সাদা বাঘ দূরে শুয়ে আছে l তারপর আবার কয়েকটা আলাদা বাঘ, কিছু দূরে আবার দেখলাম চিতা বাঘ l এই ভাবে কত যে বাঘ দেখলাম তার হিসেব রাখিনি lবাঘ সাফারি শেষ হলো এই উদ্যানে অনেক বাঘ জন্ম নিয়ে বড়ো হয়েছে, এরকম দুটি সাদা বাঘ হলো দীপক আর গঙ্গা l
এবার হাতি সাফারি, জঙ্গলের ভেতর হেঁটেই চলেছি, তার পর তাদের দেখা পেলাম l দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাস খাচ্ছে l
এবার জিরাফ l খুব সামনে জীবনে প্রথম জিরাফ দেখে খুব খুশি হলাম l এতো বড়ো বন পায়ে হেঁটে ঘোরা সত্যি ই কষ্টকর l এটুকুতেই হাঁপিয়ে উঠেছি lচারদিকে এতো কিছু কোনটা দেখবো কোনটা ছাড়বো কিছু ঠিক করতে পারছিলাম না l দেখলাম কিছু কুমির যাদের মুখ গুলো সরু সরু, জল থেকে উঠে তারা রোদ পোহাচ্ছে l কিছু দূরেই কয়েকটা চমরী গাই মনের সুখে চরে বেড়াচ্ছে l
ঢুকলাম পেঁচার গুহায় l কত রকমের পেঁচা l সেখান থেকে চলে গেলাম বনমানুষ এর আস্তানায় l গরিলা, ওরাং ওটাং দেখে পৌঁছে গেলাম সরীসৃপ পার্কে l গেটে বিরাট ট্রাইনোসোরাস এর মূর্তি l 18 প্রজাতির সরীসৃপ এখানে আছে l কত রকমের সাপ, কচ্ছপ, গোসাপ, কুমির ইত্যাদি যে দেখলাম তার ঠিক নেই l
দুপুর হয়ে গেল l এবার পৌঁছে গেলাম একটা খুব বড়ো জলাশয়ের ধারে l সেখানে জলহস্তী গুলো স্ট্যাচু এর মতো দাঁড়িয়ে আছে l চার দিকে বাঁদারেরা লাফ ঝাঁপ খাচ্ছে lকাঞ্জিলা বলে একটা বিশাল হ্রদ আছে l সেখানে পদ্ম ফুল ফুটে আছে l বোটিং করছে অনেকেই l
এবার পাখি দের মহলে ঢুকলাম l কত রকম পাখি l সাদা ময়ূর আর কালো রাজ হাঁস দেখে খুব আনন্দ পেলাম l এ ছাড়াও হাঁস মুরগি থেকে শুরু করে ছোট বড়ো শত শত পাখি খাঁচার ভেতর বন্দি l শকুন, বাজ পাখি, উট পাখি আরো কত কি !
নীল গাই, বিভিন্ন গরু, বুনো শুকর দেখলাম l
হরিনের দল ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে l সে দেখার মতো দৃশ্য l
সবার শেষে গেটের দিকে রওনা দিলামl ঢুকলাম আয়কোয়ারিয়ামের দেশে l সেখানে মাছ কত রকমের, পিনহারা মাছ দেখলাম সচক্ষে l
বিকেল হয়ে গেল সব ঘুরতে ঘুরতে, এবার ফেরার পালা l বন্ধুদের ফোন করে খুঁজে বার করলাম l বাইরে বেরিয়ে খাবার খেলাম l
নন্দনকানন সম্পর্কে কিছু তথ্য :400 হেক্টর বা 990 একর জায়গা জুড়ে এটি অবস্থিত l ভুবনেশ্বর থেকে কিছুটা দূরে l নিকটবর্তী স্টেশন – Barang প্রতিষ্ঠা -1960, চালু হয় -1979, 134 একর কাঞ্জিলা হ্রদ ,নন্দনকানন কথার অর্থ স্বর্গের উদ্যান lপ্রতি বছর 3.3 লক্ষ পর্যটক ঘুরতে আসেন l 1660 প্রাণী, 166 বর্গের প্রাণী যার মধ্যে
67 স্তন্যপায়ি ,18 সরীসৃপ ।34 টি আকোয়ারিয়া
5000sq ft অর্কিড বাগান l
তালসারি, উদয়পুর, চন্দনেশ্বর মন্দির দীঘা ঘুরতে গিয়ে হাতে সময় থাকলে তালসারি, উদয়পুর সবাই যেতে বলেন l তাই আমরাও ভাবলাম যাওয়া যাক l সেপ্টেম্বর মাসের 24 তারিখ 2018, আমরা একটা টোটো ভাড়া করে ছ’জন চললাম তালসারি l
তালসারি নিউ দীঘা থেকে কিছু কিলোমিটার দূরে একটা অতি সুন্দর, নিরিবিলি সাদা বালির সমুদ্র সৈকত l যার পূর্ব দিকে উদয়পুর পুর আর নিউ দীঘা l এই সৈকতে লাল কাঁকড়া আর এক আকর্ষণ l
দীঘার রাস্তা শেষে হলো কখন বুঝতে পারিনি, রাস্তার ধারে দোকানে ওড়িয়া লেখা দেখে বুঝলাম ওড়িশা এসে গেছি l রাস্তা কালো পিচে তৈরী l খুব সুন্দর রাস্তা l দুই দিকের নারিকেল গাছের সারি আর ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম তালসারি l টোটো থেকে নেমে চললাম, রাস্তার ধারে চশমা,টুপির দোকান l সেখানে চশমা কেনার জন্য কিছু সময় নষ্ট করলাম l তারপর পর সামনের দোকানে সকালের খাবার খেয়ে ফেরি ঘাটে গেলাম l তখন জোয়ার চলছিল l সেখান থেকে দূরে একটা দ্বীপের মতো দেখা যাচ্ছে, সেটির একদিকে গাছে ভরা l
জোয়ার থাকলে নৌকা করে যেতে হয় ওই তালসারি বীচেl ভাটা থাকলে হেঁটেই যাওয়া যায় l অনেকে মোটরবাইক ভাড়া করেও যেতে পারে l জোয়ারের সময় যেখানে এক বুক জল থাকে সেখানে ভাটার সময় এক হাঁটু বা তারও কম জল থাকে l
তালসারি সমুদ্র সৈকতের পূর্ব দিক বা মাঝ বরাবর অনেক লাল কাঁকড়া দেখতে পাওয়া যায় l সামনে গেলেই গর্তে ঢুকে যায় l দূর থেকে লাল ফুল পড়ে চারদিক ভরে গেছে বলে মনে হয় l আর তার পরেই নীল বঙ্গোপসাগর l এখানেও বাইক ভাড়া পাওয়া যায় l ঘোরা যায় বীচের শেষ পর্যন্ত l
বিস্তীর্ণ সাদা বালুকাময় এই বীচের একদিকে কিছু গাছ আছে l খুব সুন্দর হাওয়ার শব্দ আর প্রকৃতির নিজস্ব কলতান শুনতে শুনতে বালিতে হাঁটতে হাঁটতে সময় হয়ে গেল ফেরার l
উদয়পুর :
তালসারি থেকে উদয়পুর খুব বেশি দূর নয় l এটি পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত l খুব সুন্দর একটি সৈকত l একধারে লম্বা লম্বা ঝাউ গাছের বন আর একদিকে আদিগন্ত সমুদ্র l মাঝে বাঁধানো রাস্তা l আর সামনেই নৌকার সারি l জেলেদের জাল আর দোকানপাট l
শীতকালে এখানে অনেক পিকনিক হয় l ডাব পাওয়া যায় অনেক l আমরা তো বেশ বড়ো বড়ো ডাব ও কচি নারকেল খেলাম l বীচের আর একদিকে অনেক চেয়ার সাজানো আছে l এখানে বসে বসে সবাই পানীয় পান করে আর সমুদ্রের হাওয়া উপভোগ করে l স্নানও করছে অনেকেই l
আমরা নিউ দীঘায় স্নান করবো বলে সমুদ্রে না নেমেই ওখান থেকে ফেরার মনস্থির করলাম l
চন্দনেশ্বর মন্দির :এবার আমাদের গন্তব্য চন্দনেশ্বর মন্দির l বিখ্যাত এই মন্দিরটি বালেশ্বর জেলায় অবস্থিত l বালেশ্বর স্টেশন বা বাসষ্ট্যান্ড থেকে সহজেই যাওয়া যায় l দীঘা থেকেও বাস, অটো, টোটো করে যাওয়া যায় l এটি একটি শিব মন্দির l চৈত্র মাসে এখানে বিখ্যাত চড়কমেলা হয় l তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এসে তাদের অর্ঘ্য দেনl চার -পাঁচ লক্ষ্য ভক্তের সমাগম হয় l এমনিতেও সারা বছর মানুষের ভীড় চোখে পড়ার মতো l এখানে একটি পুকুর আছে l সেখানে সবাই স্নান করে মান্যত করছে মন্দিরে l কেউ বা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে আবার উঠে এগিয়ে চলেছে l সারাদিন গমগম পরিবেশ l
যাইহোক দুপুর হয়ে গেছে আমরা আবার টোটো করে ফিরতে লাগলাম lফেরার পথে আরো এক রাধা কৃষ্ণ মন্দির দেখলাম l
একদিনের এই তালসারি, উদয়পুর, চন্দনেশ্বর মন্দির ঘুরে আশা স্মৃতি হয়ে মনের মনিকোঠায় তোলা রইলো l বাসনা রাখলাম আবার যাবার l
পরের পর্ব……… ক্রমশ l