Homeএখন খবরসঙ্গে রুকস্যাক ।। মায়াদ্বীপ মৌসুনি।। মীর হাকিমুল আলি

সঙ্গে রুকস্যাক ।। মায়াদ্বীপ মৌসুনি।। মীর হাকিমুল আলি

মায়াদ্বীপ মৌসুনি                                                   মীর হাকিমুল আলি

দীঘা পুরী এগুলো বাঙালির জল ভাত হয়ে গেছে, এমনকি দীঘা তো অনেকের অসংখ্য বার যাওয়া হয়েছে এটা বলা যায় l কলকাতার কাছে আর কোথায় যাওয়া যায় এই নিয়ে সপ্তাহান্তে অনেকেই বেশ চিন্তায় পড়েন l অবশ্য অনেকে বকখালি যান l আমি বলি কী একবার মৌসুনি দ্বীপ ঘুরে আসুন একদিনের জন্য l ভালো না লাগলে বলবেন l ভালো লাগতেই হবে এটা বুক ঠুকে বলতে পারি অবশ্য যদি প্রকৃতি প্রেমী দুটি চোখ থাকে l কোথায় এই মৌসুনি দ্বীপ??? অনেক দ্বীপের নাম শুনেছেন মৌসুনি শুনেননি তাই তো??? তবে বলি শুনুন –
মৌসুনি হলো দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবনের প্রায় একশো খানেক দ্বীপ এর মধ্যে অন্যতম এক সুন্দর দ্বীপ l যা চেনাই নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন l দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর জম্বু দ্বীপ, পশ্চিমে সাগর দ্বীপ আর পূর্বে বকখালি, হেনরি আইল্যান্ড l অতি মনোরম এই দ্বীপের নামটিও বেশ মিষ্টি l
দীঘার সমুদ্রের একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠতে একদিন আমিও পৌঁছে গেলাম সবুজের সমারোহ এই দ্বীপে l আমরা চার জন আগে থেকে বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করে অনলাইনে তাঁবু বুকিং করে ফেলি l এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আগে থেকে টেন্ট বুকিং টা জরুরি তাহলে সুবিধা হয় l একই সাথে খাওয়ার প্যাকেজ l যাইহোক আমরা সকালে ধর্মতলা থেকে নামখানার বাস ধরি l  নামখানা যেতে প্রায় তিন সাড়ে তিন ঘন্টা লাগে l শিয়ালদা থেকে নামখানা ট্রেনেও যাওয়া যায়, তিন ঘন্টা লাগে l ওখান থেকে অটো বা টোটো করে হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদীর ফেরিঘাট l এখন সম্প্রতি এই নদীর ওপর ব্রীজ হয়ে গেছে তাই সুবিধা হয়েছে l কিন্তু আমরা যখন গিয়েছিলাম জুন মাস l তখন ব্রীজের কাজ চলছিল l তাই আমরা একটা নৌকায় উঠে বসলাম l বেশ রোদ গরম l দর দর করে ঘাম দিচ্ছে l কিছুক্ষন অপেক্ষা করতেই হলো নৌকা ভর্তি হতে l অবশ্য নৌকায় যাওয়ার মজাই আলাদা lতারপর এই নদী পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে কিছুটা হেঁটে বা টোটো ধরে একটা গাড়ি স্ট্যান্ডে আসতে হবে l আমরা তো হেঁটেই গেলাম l গিয়ে একটা ম্যাজিক গাড়িতে উঠলাম l সেখানেও কিছুক্ষন অপেক্ষা l তারপর গাড়ি ছাড়লো l ছুটে চললো সোজা l তারপর আমাদের নামিয়ে দিল একটা জায়গায় যেখান থেকে চেনাই নদীর নৌকা ঘাট বেশ কিছুটা দূর l আসলে আমাদের নিজেদের বলার ভুলে এরকম টা হয়েছিল l যাইহোক দুর্গাপুর ঘাট যাওয়ার জন্য আমাদের বেশ কিছুটা এই রোদের মধ্যে পায়ে হেঁটে যেতে হয় l নৌকা ঘাট যাওয়ার রাস্তা ইট দিয়ে তৈরী l দুই দিকে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ l আর অসংখ্য লাল কাঁকড়া l আমাদের যাওয়ার কিছুক্ষন আগেই জোয়ার এসেছিলো l ফলে ঘোলা জল একটু একটু করে নদীর দিকে টানা হয়ে যাচ্ছে আর কাদায় ল্যাটা মাছের মতো এক ধরণের জীব কিলবিল করছে l নদী ঘাটের কাছে গিয়ে দেখি বিশাল নদীর বিস্তার l জনমানব শুন্য এই খেয়া ঘাটে আমরা কজন রোদের প্রখরতা সহ্য করে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছিলাম l কিছুক্ষন পর দেখলাম বামদিক বেঁকে একটা যাত্রীবোঝাই নৌকা এই ঘাটের দিকে আসছে l অবশেষে সেই নৌকা আমাদের পৌঁছে দিল বাগডাঙ্গা বলে একটা জায়গায় l সেখানে একটা টোটো ভাড়া করলাম l সেই টোটো ড্রাইভারের ব্যবহার অমায়িক l যাইহোক গল্প করতে করতে যাচ্ছি সরু ঢালাই রাস্তা দিয়ে l দুই দিকে কখনো পুকুর, কখনো খাল, খেজুর গাছ, সবুজের সারি l টোটো ওয়ালা আমাদের নিয়ে গিয়ে একটা জায়গায় নামিয়ে দিয়ে বললেন একটু হেঁটেই গেলেই তাঁবু দেখতে পাবেন l
আমরা আমাদের গন্তব্যে পোঁছে দেখলাম 2টি ছোট তাঁবু আর পাঁচ /ছটা বড়ো তাঁবু আছে l আমরা যেতেই একজন বাচ্চা আমাদের তাঁবু দেখিয়ে দিল l আমরা ব্যাগ রেখে দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আনন্দে সব ক্লান্তি দূর করে ফেললাম lগাছে বাঁধা দোলনাতে শরীর এলিয়ে দিলাম l তারপর আমাদেরকে একটি করে ডাব কেটে খেতে দিল একজন l এই গরমে ডাবের জল দিয়ে অভ্যর্থনা বেশ ভালোই লাগলো l
মাছ সহ বেশ কিছু উপাদেয় পদের উপযোগে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে আমরা একটু বিশ্রাম নিলাম দোলনায় বসে l একদম নির্জন সৈকত l তারই 50 মিটারের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এই ব্যাকওয়াটার ক্যাম্প l বেড়া দিয়ে ঘেরা l কয়েকটা তাঁবু, বাথরুম, দোলনা, বসার টুল, কয়েকটা চেয়ার, একটা বড়ো টেবিল, একটা তক্তপোষ, রাতের জন্য কয়েকটা হারিকেন আর সমুদ্রের গেটের দিকে একটা বসার খোলামেলা গোল বৈঠকখানা l চারদিকে বালি, ঘাস, বড়ো গাছ কয়েকটা আর সবুজের ভীড়, সারি দেওয়া 3/4 টি মাটির নির্ণীয়মান কটেজ, তার পেছনে পুকুর, খেজুর গাছ ও পার দিয়ে মাটির সরু রাস্তা —এই হলো চারদিকটার পরিবেশ l সমুদ্রের দিক ঢালু যা মিশেছে বিস্তীর্ণ বালুতটে আর শেষে সমুদ্রে l তাঁবুর ভেতর থেকে আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র যেমন দেখা যাচ্ছে তেমনি তার জলকণা মিশিত সুশীতল বাতাস ও এসে শরীর মন জুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে l ঢেউয়ের মৃদু গর্জন ও কর্ণকুহর ভেদ করে অন্তরে পুলক বর্ষণ করছে l প্রখর রোদ তার ওপর ভ্যাপসা গরমে সমুদ্রে স্নানের তৃস্না বাড়তে লাগলো l আর বসে থাকা যায়না l স্নানের পোশাক পরে বালুতট পেরিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলেl সুশীতল জলের সংস্পর্শে শরীর জুড়িয়ে গেল l আমরা সমুদ্রে বেশ কিছুক্ষন স্নান করলাম l জলের ঢেউ খুব বড়ো বড়ো নয় তাই জলের মধ্যে খুব বেশি নাচন কুদন হয়নি l পায়ে বালির বদলে কখনো কাদাও লাগছিলো l জল কিন্তু খুব স্বচ্ছ নয়, কিছুটা কাদানেl এখানে দীঘা বা অন্যান্য বীচের মতো ভীড় মোটেও হয়না তাই বালির ওপরে পাতলা কাদার আস্তরণ পরিষ্কার বুঝতে পারলাম l অবশ্য আমরা যখন স্নান করি তখন বিকেল প্রায় l তাই জোয়ার ছিল না lতাই জল অনেকটা দূরে নীচের দিকে নেমে গেছে l নাহলে জল তাঁবুর একেবারে সামনে ছলাৎ ছলাৎ করতে থাকে l যাইহোক সমুদ্র থেকে উঠে বাথরুমে আবার স্নান করে আমরা সৈকত বরাবর পশ্চিমদিকে ঘুরতে বেরোলাম l আমাদের সঙ্গ দিল ক্যাম্প এর একজন স্টাফ যিনি আমাদের কাছে ডকুমেন্ট যাচাই করা, খাবার সহ বাকি পরিষেবা গুলো ঠিকঠাক দেওয়া হচ্ছে কিনা দেখাশোনা করা ইত্যাদি কাজ করেন, নাম সুমনl তারপর তিনি আমাদের নিয়ে কিছু টা দূরে ঘুরতে নিয়ে গেলেন l সেদিকে কয়েকটি জেলেদের বাড়ি l বাড়ির সামনে নৌকা, জাল পড়ে আছে l ঝড় হলেই এরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় l কিছুদিন আগের ঝড়ে গাছ গুলি ডাঙ্গার দিকে নুয়ে আছে l তালগাছ গুলো ন্যাড়া মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে l গরমের এরকম বিকেলে সমুদ্রের ভুরভুরে হাওয়ায় দৈনন্দিন কাজের চাপ, চিন্তা কোনদিকে অজান্তে উবে গেল l এদিক ওদিকে ঘোরাঘুরি সাথে গল্প গুজব,ছবি তোলাও হলো lসন্ধ্যা হয়ে এলো আমরা টেন্টে ফিরলাম l বাইরে বৈঠকখানায় বসে আমরা চা, মুড়ি, তেলেভাজা খেতে খেতে গল্প করছিl ততক্ষনে তাঁবুর বাইরে একটা করে লণ্ঠন জ্বলে উঠেছে l মৃদু আলোয় চারদিক বড্ডো মায়াবী লাগতে লাগলো l জোনাকি উড়ছে আর ঝিঁঝি পোকা ঝিঁ ঝিঁ করে ডাকছে l সমুদ্রের দিকে মৃদু জোৎসনার আলোয় ঢেউয়ের শেষ ওঠাপড়া দেখা যাচ্ছে l আর ঢেউ আছঁড়ে পড়ার মিষ্টি গর্জন কানে আসছে lসারমেয় গুলো ঘোরাফেরা করছে l কেউ বা বালির ওপর গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে l পাশেই আগুন জ্বালিয়ে চিকেন কাবাব বানাচ্ছেন কয়েকজন ক্যাম্প কর্মী l বাকি পর্যটক রা সৈকতে বসে হৈচৈ হুল্লোড় করছে lস্থানীয় কিছু ছেলে বুড়ো সৈকতে ঘুরছে, ফোন করছে, কেউ বা বাড়ি ফিরছে জাল নিয়ে l বসে বসে হলো না l বেরিয়ে পড়লাম সৈকতে l খুব আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে l আর মাঝে মাঝে কেউ কেউ বসে গল্প করছে l একটা ছেলের সাথে সখ্যতা জন্মে গেল আমার l বসে বসে গল্প করলাম lএই দ্বীপ, গ্রাম সম্পর্কে কত কিছু জানতে পারলাম l তাদের দারিদ্রতা, অসহায়তার গল্প l বিভিন্ন আধুনিক সুযোগ সুবিধা এখানে তারা পায়না l যেতে হয় শহরে যা দুটি নদী পেরিয়ে বহু সময় ব্যয় করে তাদের যেতে হয় l আগে এতো পর্যটক আসতো না l কিছুদিন হলো এই জায়গাটি পর্যটক দের প্রিয় হয়ে উঠেছে l ফলে গ্রামের ভেতরে টোটো চলছে l বর্ষা কালে বন্যায় প্রায় ডুবে যায় চারদিক l ঝড় এদের খুব ভয় এর ব্যাপার l এসব গল্প করতে করতে কখন যে রাত নয় টা বেজে গেল বুঝতেই পারিনি l খেতে হবে তাই উঠে গেলামl বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে তাঁবুর সামনে গেলাম l রাতে মুরগির মাংস আর কয়েকটা পদ দিয়ে উদর পূর্তি করে তাঁবুর ভেতর ঘুমোতে গেলাম l সমুদ্রের বাতাস তাঁবুর ভেতরে কিন্তু সেভাবে ঢুকলো না l তাই গরমও লাগছিলো l মশা চারদিকে গান শোনাচ্ছে, কুকুর লড়াই লেগে যাচ্ছে যখন তখন lঘুম ঠিক মতো হলোনা l জীবনে এই প্রথম তাঁবুর ভেতরে তাও আবার একেবারে সমুদ্রের তীরে ঘুম না হওয়ায় স্বাভাবিক l যাইহোক সারারাত ঢেউ গুনে গুনে সকাল হলো l আমরা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সূর্যোদয় দেখতে l কিন্তু মেঘ ছিল আকাশে l দেখতে পেলাম না l হেঁটে হেঁটে পূর্ব দিক থেকে ঘুরে এসে ব্রেকফাস্ট করে গ্রাম পরিভ্রমনে বেরোলাম l গ্রামটি বেশ মনোরম l মানুষজন সহজ সরল l খেজুর, তাল, ঝাউ, নারকেল, আম,জাম, কাঁঠাল গাছের সমারোহ l ছোট ছোট খড়ের চাল দেওয়া মাটির বাড়ি l প্রাইমারি ও হাই স্কুলও চোখে পড়লো l গ্রামের লোকেরা বেশিরভাগ মৎসজীবি ও চাষী l খুব সাধারণ জীবনযাপনl সৌর বিদ্যৎ কিছু কিছু বাড়িতে দেখা যাচ্ছে l মেঠো ঝাউ বনের পথে আড্ডা দিলাম কিছুক্ষন l ঝিরি ঝিরি হাওয়া দিচ্ছিলো lগ্রাম ঘুরে এসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে, স্নান করে, দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা বাড়ি আসার জন্য রওনা দিলাম l ফেরার সময় বিকেল নামখানা থেকে লোকাল ট্রেন থাকে l তাতেই উঠে বসলাম l ফিরতে আমাদের রাত হলো l ফিরে এলাম ঠিক ই কিন্তু মন পড়ে রইলো সেই মায়াদ্বীপে l

এই ব্যাকওয়াটার ক্যাম্প এর খাবার দাবার প্রশংসনীয় l একদম ঘরোয়া বাড়ির খাবারের মতো ও অতি সুস্বাদু l নিয়োজিত দাদা /ভাই গুলির ব্যবহার খুবই ভালো l গরমের দিনে ঠান্ডা জলের সমস্যা খুব l এখন আরও কয়েকটা রিসর্ট হয়েছে হয়তো l আরও উন্নত পরিষেবা পাওয়া যেতে পারে l তবে বেশি ভালো পরিষেবা দিতে গিয়ে গ্রাম্য গন্ধটাই না চলে যায় সেই আশঙ্কা l

কিভাবে যাবেন বলেছি যদিও তাও একবার :
শিয়ালদা থেকে নামখানা পর্যন্ত ট্রেন অথবা ধর্মতলা থেকে নামখানা পর্যন্ত বাসে —-এখন ব্রীজ হয়ে গেছে তাই সেটাও হয়তো গাড়িতে পেরিয়ে পরের স্টপে ম্যাজিক গাড়ি (শেয়ার ) করে বাগডাঙ্গা নৌকাঘাট —-চেনাই নদী নৌকায় পেরিয়ে মোসুনি দ্বীপ l নৌকা থেকে নেমেই পেয়ে যাবেন অনেক টোটো l ভাড়া করে সুন্দর রাস্তা বেয়ে পৌঁছে যান বালিয়াড়া গ্রাম l                                                                           #থাকা খাওয়া বুকিং এর জন্য comment box a contract করতে পারেন।খরচ কেমন হতে পারে?আমরা যখন গিয়েছিলাম 2018 জুন মাসে তখন প্রত্যেকের 1500 টাকা করে খরচ হয়েছিল l ছোট তাঁবু ছিল 1000, বড়ো তাঁবু ছিল 1200. (2টা মিল, টিফিন, চা ইত্যাদি সহ) lএকটা তাঁবুতে 2জন l বড়ো গুলিতে 4 জন থাকতে পারবে l এখন অবশ্য কেমন দাম বলতে পারছিনা l একটু বেশি হবে নিশ্চয়ই l এখন একজনের 2000-2500 খরচ হবে আশা করি l বেশিজন গেলে খরচ কমতে পারে l

RELATED ARTICLES

Most Popular