পলাশ খাঁ :- শালবনীর প্রায় পুরো এলাকাটাই জঙ্গল, সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ৪০কিলোমিটার বিস্তৃত জাতীয় সড়ক আর তারও দ্বিগুন রাজ্য সড়ক! দু’হাজার বর্গ কিমি জঙ্গলের মধ্যে ঠেসে ঢুকে আছে কয়েকশ গ্রাম। এই বিশাল এলাকার আইন শৃঙ্খলা আর নানা রকমের ঝক্কি পোহাতেই কেটে যায় ২৪ঘন্টা। পুলিশের চাকরির বাইরে গিয়ে আর কিছু করার উপায় কোথায়? কিন্তু মেয়ের আবদার ছিল নিজের জন্মদিনটা অন্যভাবে পালন করার। মেয়ের সেই আবদারের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল পেশার বাইরে গিয়ে কিছু একটা করার। কিন্তু বাধ সাধল সেই পুলিশের পেশাই। মেয়ের আবদার মেটানোর সময় দিতে পেরিয়ে গেল পাক্কা তিনদিন। ৫ই জানুয়ারির পরিবর্তে ৮ই জানুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনী থানার ইন্সপেক্টর ইনচার্জ বা IC গোপাল সাহা সপরিবারে চলে গেছিলেন এক শবর গ্রামে। যেখানে তাঁর মেয়ের বয়সী ছেলেমেয়েদের কঠিন জীবন।
গোপাল সাহা জানিয়েছেন, ” উত্তরবঙ্গ থেকে এই জঙ্গল মহলে আসার পরে পরেই শুরু হয়েছিল অতিমারি জনিত লকডাউন, আর সেই লকডাউন জনিত গরিব মানুষদের দুর্বিসহ জীবন। সেই সময় মূলত পুলিশকেই পালন করতে হয়েছে সমস্ত দায়িত্ব। রেশন থেকে চিকিৎসা সবই তখন পুলিশের কর্তব্য হয়ে যায়। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই হয়ত এই সব মানুষদের দুঃখ, যন্ত্রনা কখনও বাড়িতে শেয়ার করছি। আমার একরত্তি মেয়ের মধ্যে তার ছাপ কখন পড়ে গেছে টের পাইনি। তাঁরই আবদার ছিল লকডাউনের অসহায় সেই পরিবার গুলির বাচ্চাদের সাথেই সে পালন করবে তার জন্মদিন। আমি সেদিন সময় দিতে পারিনি। সে বলেছে তুমি যেদিন সময় দেবে সেদিনই আমার জন্মদিন পালন করব কিন্তু করব ওদের সাথেই।”
দশ বছরের সেই একরত্তি মেয়ে অদৃতার আবদার মেনেই মেয়েকে নিয়ে বিশ্বাস পরিবার পৌঁছে যায় শালবনীর প্রত্যন্ত পিছিয়ে পড়া শবর জনজাতির গ্রাম বুড়িশোলে। বাবা-মায়ের সাথে নুন আনতে পান্তা ফুরানো সেই পরিবার গুলির কচিকাঁচা দের সঙ্গে নিয়ে অদৃতা পালন করলো নিজের জন্মদিন। গ্রামের পিছিয়ে পড়া কচিকাঁচা দের সঙ্গে সারাদিন হৈ-হুল্লোড়, দুপুরে কব্জি ডুবিয়ে একসাথে ভুরিভোজ আর বিকেলে উপহার হিসেবে তুলে দিল বই, খাতা, কলম, রঙপেনসিল৷
গোপাল বিশ্বাস এবং তাঁর স্ত্রী কোয়েল বিশ্বাসের ইচ্ছা এবং অদৃতার আবদার মেটাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় শালবনীর “ছত্রছায়া”কে। সেই মতো বিশ্বাস পরিবার ছত্রছায়ার নতুন ঘোষ সহ কয়েকজন পরিচিত সমাজসেবী কে নিয়ে শুক্রবার সকালেই পৌঁছে যান শালবনীর সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া গ্রাম বুড়িশোলে। যে বুড়িশোল মুলত শবর অধ্যুষিত গ্রাম৷ বিশ্বাস পরিবার গ্রামে পৌঁছাতেই গ্রাম জুড়ে শুরু হয় উৎসব৷
অদৃতা সারাদিন ধরে গ্রামের শবর কচিকাঁচা দের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে যায়৷ চলে দুপুরের মধ্যাহ্নভোজ৷ বিশ্বাস পরিবারের উদ্যোগে গ্রামের দেড়শতাধিক শিশুর কব্জি ডুবিয়ে পেটপুরে মনের আনন্দে মধ্যাহ্নভোজ সারে৷ মেনুতে ছিল সাদা ভাতের সঙ্গে মুগের ডাল, ফুলকপির তরকারি, মাছের ঝাল, মাংসের ঝোল, চাটনি, পাঁপড়, পায়েস। আর শেষ পাতে নলেন গুড়ের রসগোল্লা। আর রান্না থেকে পরিবেশন একা হাতে সামলান অদৃতার মা কোয়েল৷ জন্মদিনের এই অনুষ্ঠানে যোগদানকারীরা জানান কোয়েল দেবী যেন আজ স্বয়ং অন্নপূর্ণা হয়ে উঠেছিলেন। মধ্যাহ্নভোজের পর প্রতিটি শিশুর হাতে অদৃতা উপহার তুলে দেয় বই, খাতা, কলম রংপেন্সিল।
এদিনের বিশ্বাস পরিবারের এই মহতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বুড়িশোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অভিজিৎ ঘোষ, সহকারী শিক্ষক বিপ্লব মুখার্জী ও পার্শ্ব শিক্ষক বিশ্বশান্তি নায়েক সহ অন্যান্যর। আদৃতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি তারা জানান, এই ধরনের আয়োজনে অংশ হতে পেরে তাঁরা গর্বিত। আর অদৃতার বাবা মা গোপাল বাবু ও কোয়েল দেবী জানান, সত্যি ভাবতে অবাক লাগে আমাদের সমাজে এখনো কতো মানুষ এই রকম পিছিয়ে রয়েছে৷ তাদের সঙ্গে এই ভাবে সময় কাটাতে পেরে আমরা খুবই খুশী৷ অদৃতা ছোটো থেকেই এই রকম। পরের কষ্টের কথা শুনলেই তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করে তার সাধ্যমতো। লকডাউনেও নিজের জমানো টাকা থেকে বেশ কিছু অসহায় মানুষের হাতে খাদ্য সামগ্রী তুলে দিয়েছিল৷