নিত্য গুপ্ত: বয়স ১৪, ক্লাশ নাইনের ছাত্র তারই কাঁধের ওপর ১২ বছরের বোনের লাশের ভার চাপিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে বাবা মা, সমাজ। খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে হতবাক এই নাবালকের প্রশ্ন বনু (বোন)র লাশ নিয়ে আমি কী করব ? যে প্রশ্ন তাড়িত করেছে মহকুমা হাসপাতালে আসা রোগী কিংবা রোগীর আত্মীয়দেরও। কিশোর উত্তর খুঁজেছে কিন্তু উত্তর মেলেনি। ফলে পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং থানার বড়চারা গ্রামের ওই কিশোর সুদীপ নায়েক দ্বিধা গ্রস্ত।
ঘটনা মঙ্গলবার সন্ধ্যেবেলার। সুদীপের বনু ১২বছরের মন্দিরা কেন তখনও সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালায়নি এই নিয়ে তাকে বকাবকি করে বাবা মা। বাবা বীরেন নায়েক আর মা সরস্বতী দুজনেই জনমজুরির কাজ করে সংসার প্রতিপালন করেন। দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে সুদীপ বড় আর মন্দিরা ক্লাশ সিক্সে পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দেয়, কন্যাশ্রী হয়ে ওঠা হয়নি। কেন পড়া ছেড়ে দিল, ড্রপ আউট থেকে তাকে বের করতে আনতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কিনা এসব বিষয় এখানে অবান্তর কারন এখন মর্গে পড়ে রয়েছে ছোট্ট মেয়েটার কাটাছেঁড়ার পর গুনসুঁচ দিয়ে সেলাই করা লাশ। না, কন্যাশ্রী বলা যাবেনা ড্রপআউট মেয়েকে।
তো এই সমাজ যেমন নিজে নিজেই ছোট মেয়েকে আদর করে মা বলে ডাকে আর নিজের অজান্তেই মায়ের সব কাজ ছোট্ট মেয়েটার কাঁধে চাপিয়ে দেয় তেমনই মন্দিরাকে সন্ধ্যা দিতে হত। মন্দিরা কেন সেদিন সন্ধ্যা দেয়নি তা বলা মুশকিল কারন সে এখন লাশ, উত্তর দিতে পারবেনা। ধরে নেওয়া যেতেই পারে সে মঙ্গলবার সন্ধ্যা বেলায় তার ১২বছরে ফিরে যেতে চেয়েছিল, ঘর গেরস্থালি তার ভাল লাগেনি, সে তো মাত্র ১২ বছর তারা বালিকা হওয়ার অধিকার ছিল। কিন্তু তার এই বেয়াড়াপনা সহ্য হয়নি বাবা মায়ের। যেমনটা কোনও বাবা মায়ের হয়না। বড় হয়ে ওঠার জন্য শাসনের প্রয়োজন হয় তাই তাকে চড় চাপাটি মারা হয়। এরপর অভিমানী মেয়ে বাড়িতে রাখা কীটনাশক খেয়ে নেয়, মারা যায়। মরে গিয়ে জিতে গেল জেদি মেয়ে, ১২ বছরেই থেকে গেল সে। হুঁ হুঁ, বাবা সমাজ তুমি যতই টানাটানি কর ওকে আর বড় করতে পারবেনা!
এদিকে মেয়ে মারা গেছে জানতে পেরেই পুলিশের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে বীরেন আর সরস্বতী। তাঁদের ভয় মেয়ের মৃত্যুর জন্য পুলিশ তাদের ধরবে। এরপর পুলিশ কী করবে?
বুধবার সকালে মন্দিরার লাশ সবং হাসপাতাল অবধি এনেছিল সুদীপ আর কয়েকজন প্রতিবেশী কিন্তু খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য আসতে রাজি নয় কেউ। অগত্যা পুলিশের অবলম্বন সুদীপ। না, এখানে পুলিশ তার সঙ্গে একজন পুলিশ কর্মীকে দিতে পারত কিনা, স্থানীয় পঞ্চায়েত উদ্যোগ নিয়ে কিশোরের সঙ্গে লোক পাঠাতে পারত কিনা এসব প্রশ্ন অবান্তর কারন আপাতত ভোট নেই আর হতদরিদ্র আদিবাসী পরিবারের তেমন নাম ডাকও নেই।
অতএব পুলিশের লাশ তুলে দেওয়া গাড়িতে চালকের সঙ্গে সুদীপ একাই। ১২বছরের বনুর অভিভাবক ১৪বছরের দাদা! তারপর কাটাকুটি করে চারঘণ্টা ঠায় বসে থাকা। পকেটে পয়সা নেই, পেটে দানাপানি নেই। আর খাবারই বা কী দরকার? লাশ সঙ্গে রেখে খেতে নেই, কচি পেটও সামাজিকতা বোঝে! ডোম কিছু খরচা পানি চেয়েছিল। দিলে নাকি এমন করে সেলাই করে দেবে যে বুঝতেই পারা যাবেনা! যেন, ওই সেলাইয়ে বেঁচে উঠবে মেয়ে। সুদীপ টাকা দিতে পারেনি, ওই যে বললাম, পকেটে ফুটো কড়িও নেই।
এরপর লাশ নিয়ে কী করবে ভেবেই পাচ্ছেনা সবংয়ের ওই নাবালক। লাশ নিয়ে পোড়াতে কিংবা কবরে দিতে হবে। মা নেই, বাবা নেই, প্রতিবেশী নেই! কিন্তু চালককে ফিরতে হবে, অতএব লাশ চলল বড়চারা। শেষ অবধি জানা গেছে সৎকারে লোক জুটেছিল, পঞ্চায়েতের উদ্যোগ ছিল। হেঁ হেঁ ,শ্মশানে রাজনীতি খুঁজবেননা। খড়গপুরের ফাঁকা জায়গায় আপনি কী করলেন, না করলেন সবং দেখতে যাবেনা কিন্তু সবংয়ের শ্মশানে আপনার ভূমিকা সবাই দেখবে তাই সমস্যা হয়নি কোনও। সব্বাই ছিল। বলতে পারেন, জমজমাট শ্মশানকাব্য।