নরেশ জানা ও নিউজ এজেন্সি : নিচের তলার মেঝেতে মার্বেলের কাজ এখনও কিছু বাকি, ওপরের তলায় বাইরের অংশে প্লাস্টারের কাজ চলছে। একটু একটু করে সব হবে কিন্তু তার মধ্যেই আগে ঠিকঠাক করে নিতে মায়ের জন্য একটা আলাদা কামরা। বড় হয়েছেন মাটির বাড়িতে, বন্যা কবলিত এলাকায় প্রায় জল ঢুকে যেতে দেখেছেন ছোটবেলায় তাই চাকরি পেয়েই একটা বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করে ছিলেন শ্যামল। বাবার সঙ্গে সেই বাড়ির কাজ নিয়েই কথা হচ্ছিল। শুক্রবার বেলা ১২টা নাগাদ বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই, তোমাকে পরে ফোন করছি বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিলেন শ্যামল। বাবা বুঝতেই পারেননি কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার জারিপোৱা এলাকার ছোট্ট একটা পাহাড়ি নদীর সেতুর কাছাকাছি চলে এসেছিল সবংয়ের সিংপুর গ্রামের বীর জওয়ান ২৭বছরের শ্যামল দে। জায়গাটার নাম পড়শাহীবাগ আর সেই থেকেই সেতুটার নামও পড়শাহী সেতু। জেলা অনন্তনাগ হলেও জায়গাটা কাশ্মীরের কুলগাম জেলার গায়ে। নিকটবর্তী শহরটার নাম বিজবেহারা।
বাবার ফোনটা কেটে দিয়েছিলেন শ্যামল কারন তাঁর মনে হয়েছিল সেতুটাকে ঘিরে কোনও ফাঁদ থাকতে পারে। সিআরপিএফের ৯০নম্বর ব্যাটালিয়নের কনস্টেবল শ্যামল আর তাঁর সঙ্গীরা সংখ্যায় একটা প্ল্যাটুন (৩৩ জনের কাছাকছি) যাচ্ছিল রাস্তাটা কভার করতে করতে ওঁদের ভাষায় রোড ওপেনিং পার্টি। এ রাস্তায় এক সঙ্গে হাঁটা বারন, সামরিক কৌশল মেনে বেশ কিছুটা দূরত্ব রাখতে হয় পারস্পরিক যাতে গ্রেনেড বা মাইন হামলা হলে একই সাথে অনেকে হতাহত না হয়ে পড়ে। শ্যামল আগে, সবার আগে সামনেই পড়শাহী সেতু। সেতুটা পেরুনোর আগে একবার দুপাশ দেখে নিয়েছিলেন আর তারপর সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে দেখলেন রাস্তার ওপর একটা বাচ্চা ছেলে হাঁটছে!
‘এই হুঁশিয়ার বলে চিৎকার করে উঠেছিল শ্যামল । শিশুটি তার দিকে তাকাল আর সেও শিশুটির দিকে। একটা নিষ্পাপ মুখ, একটু অসতর্কতা! সঙ্গে সঙ্গে বুম বুম করে আছড়ে পড়ল কয়েকটা গ্রেনেড। কিছু বোঝার আগেই শ্যামল লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে, ছিটকে পড়ল শিশুটিও। শ্যামলের সঙ্গীরা পজিশন নিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছেন। যে সাঁজোয়া বাহিনীর জন্য শ্যমলরা রাস্তা নিরাপদ করতে করতে যাচ্ছিলেন তাঁরাও এসে পড়েছেন। কিন্ত না পালিয়ে গেছে জঙ্গীরা। শ্যামল আর শিশুটিকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া হল বিজবেহেরা হাসপাতালে কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হয়নি কাউকেই। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে ৮ বছরের ওই শিশুটির নাম নিহান যাওয়ার। জারিপোরা গ্রামেই তার বাড়ি।
শ্যামলের বাবা বিমল দে একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জানিয়েছেন, বেলা ১২টার সময় কথা হয়েছে ছেলের সঙ্গে, নির্মীয়মান বাড়িটির কিছু মালপত্র কেনা নিয়ে। সিআরপিএফ সূত্রে জানানো হয়েছে বেলা ১২টা ১০মিনিটে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। বেলা দেড়টা নাগাদ শ্যামলের বাবার কাছে ফোন আসে, সব শেষ। ২০১৫ ফেব্রুয়ারিতে চাকরি পেয়েই মা শিবানীকে জড়িয়ে ধরে ছেলে বলেছিল, “একটা বাড়ি বানাবো আর তোমার জন্য একটি আলাদা রুম।” মা হেসে বলেছিলেন, “পাগল ছেলে, তোর জন্য বাড়ি হবে, তোর বউ আনব।”
সেই বিয়েরই কথাবার্তা চলছিল। গতবছর ডিসেম্বরে শেষ এসেছিলেন, দু’একটি পাত্রীর খোঁজ মিলেছিল এবছর মে মাসে আসার কথা ছিল শ্যামলের, এলে বিয়ের কথা চূড়ান্তই হয়ে যেত হয়ত কিন্তু লকডাউনে আসা হয়নি। কিন্তু এবার আর লকডাউন আটকাবেনা, কফিনবন্দি হয়ে শ্যামল ফিরবেই। সবংয়ের সিংপুর গ্রামের অগণিত মানুষ চোখের জলে তার আসার পথে ভিজিয়ে দিচ্ছেন। শহীদের গায়ে যেন একটুও ধুলো না লাগে।