✍️কলমে: রানু পাহাড়ি
জেনারেশন গ্যাপ
রুমকি নতুন বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছে । শাড়ি পরাটা ঠিক আয়ত্ত করতে পারেনি । বাপের বাড়িতে চুড়িদার নাইটি পরে কাটিয়ে দিত । শাশুড়ি মা নতুন বউকে সকালে নাইটি পরা অবস্থায় দেখে ভীষণ গম্ভীর গলায় বলেন, “বৌমা আমার বাড়িতে এসব চলবে না সব সময় তোমাকে শাড়ি পরেই থাকতে হবে।”
রুমকি খুব শান্ত স্বরে বলে, “আমি শাড়ি পরে রাত্রে শুতে পারি না । খুব অস্বস্তি হয়।”
শাশুড়ি মা নমনীয় স্বরে বলেন, “বেশ রাত্রে পরো। সকালে সবার অগোচরে ঘরের মধ্যে নাইটি ছেড়ে শাড়িটা পরে বাইরে আসবে । আমার শাশুড়ি হলে এটুকুও মানতো না । তখন শাড়ি পরার সঙ্গে সঙ্গে একহাত ঘোমটা টেনে থাকতে হতো । তোমাকে তো তাও এসব বলিনি । ” রুমকি চুপচাপ মেনে নেয়।
সুবিনয় দুটো টিকিট নিয়ে এসে চুপিচুপি রুমকিকে দেখায় । ও খুশিতে ঝলমল করে ওঠে, “কোথায় যাবে ?”
“দেখো ” বলে টিকিট দুটো রুমকির হাতে তুলে দেয় ।
“ইস ! দার্জিলিং ! সবুজে ঘেরা পর্বতশ্রেণী !আমার ছোটবেলার কত স্বপ্ন !”
“স্বপ্ন পূরণ করতে হলে মাকে কিন্তু রাজি করাতে হবে । ওটা তুমি করবে । আমি মাকে বলতে পারব না ।”
রুমকি সুমিষ্ট গলায় বলে, “আচ্ছা লাজুক বর জুটছে আমার ! ” যথারীতি রুমকি খুব সলজ্জে ও আড়ষ্ট সহকারে শাশুড়ির কাছে আবেদন পেশ করে। তিনি বলে ওঠেন, “এখন দিনকাল কত বদলে গেছে । বিয়ের মাস ঘুরতে না ঘুরতেই তোমরা বেড়াতে যাবে আর আমার সময় বাপের বাড়ি যাওয়ার পারমিশনটুকু পেতে বছর গড়িয়ে গিয়েছিল । যাও আর কী
বলবো ।”
শাশুড়ি নিস্পৃহ গলায় বলেন ।
এই ভাবে বিভিন্ন বাধানিষেধের বেড়াজালে বন্দী হতে রুমকির বিবাহিত জীবন কাটে । যথাসময়ে ছেলের মা হয় । মনে মনে ভাবেন তার যখন বৌমা আসবে সে তখন তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে । পোশাক-আশাক ,বেড়ানো ,বাইরে বেরোনোর …কোনো নিয়মের জালে বাঁধবে না ।
তিরিশ বছর পার । এখন শাশুড়ি মা আর বেঁচে নেই । তবুও সেই নিষেধের বেড়াজাল মনের মধ্যে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে যে সেখান থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না । বৌমা নীরা একটা জিন্স আর টপ পরে স্কুটির চাবিটা দুলাতে দুলাতে বলে ওঠে, “মা আমি একটু বেরোচ্ছি ।”
নীরার পোশাক – চালচলন সবটাই ওর চোখে বড্ড দৃষ্টিকটু লাগে। নাইটি চুড়িদার পরে ঠিক আছে তাই বলে বৌমা জিন্স টপ পরেছে ,স্কুটি চালাচ্ছে কেমন একটা লাগে যেন । “নতুন বিয়ে হয়েছে বাবুকে নিয়ে বেরো ও ।” রুমকি ছোট্ট একটা উপদেশ দেয়। নীরার চোখে মুখে একটা তাচ্ছিল্যমিশ্রিত হাসি “আমি এসবে অভ্যস্ত। আর আপনার ছেলের অপেক্ষায় বসে থাকলে আমার কোনো কাজই হবে না । আমি আসছি ।”
নীরা বেরিয়ে যায় । রুমকি তার দৃপ্ত ভঙ্গির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে । সে তো মনে মনে ভেবেই রেখেছিল ,সে যে স্বাধীনতাগুলো পায়নি সেগুলো থেকে তার পুত্রবধূকে কখনো বঞ্চিত করবে না। কিন্তু তাই বলে এরকম স্বাধীনতা ! সে আশা করেনি। একটা চোরা হাসি তার চোখেমুখে খেলে যায় । একেই বলে বোধহয় জেনারেশন গ্যাপ।