যৌবনকাল

✍️কলমে: দীপ মুখোপাধ্যায়

(পর্ব–১০)

আমার ভবঘুরে এবং অনিশ্চিত জীবনযাপনে সাংবাদিকতার চাকরি কিংবা সাহিত্য অনুরাগ তখন প্রায় পূর্ণচ্ছেদপ্রাপ্তির দিকে অগ্রসর হতে থাকে।বাউলসঙ্গ,পূণ্যেচ্ছাবোধ,নিরবচ্ছিন্ন নিসর্গ ও নারী সম্ভোগ কিংবা ব্যতিরেকি যাপনচিত্র অনেক ম্লান প্রতিপন্ন হচ্ছে। আবেগ-আচ্ছন্ন যৌবনের নির্বোধ অহংকার,বিস্তৃতি এবং গভীরতা হারিয়ে ফেলছিল।আড্ডাক্ষেত্রগুলোও বেশ ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে। সত্তর দশককে পেছনে ঠেলে দিয়ে মেসবাড়ি থেকে প্রায় কপর্দপশুন্য হয়ে তাই ফিরে গিয়েছিলাম বাবা-মার আশ্রয়ে। পিতৃদেবের উমেদারিতে পাব্লিসিটি এক্সিকিউটিভ হিসেবে ঢুকে পড়েছি একটি প্রখ্যাত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। কিন্তু এসব যে আমার ধাতে সয় না। ছ-মাসের মধ্যেই পিতৃদেবের স্বপ্ন খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ল। নিজেকে ছিন্ন করলাম সেই সুখের চাকরি থেকে। হৃদয়হীন ভেদবুদ্ধি উজাড় করে মনে মনে নিজেকে বললাম,বাবা,তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। কিন্তু লোয়ার ডিভিশন এক্সিকিউটিভ হতে আমি জন্মাইনি।

বিষণ্নতার স্লথচেতনায় যখন খাবি খাচ্ছি তখন প্রায় পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো কোনও মুরুব্বি ধরা-করা ছাড়াই ভারত সরকারের একটি রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থা আমাকে মূখ্য জনসংযোগ অধিকর্তা হিসেবে নিয়োগ করল। এই পেশায় গুরু ঠাউরে নিলাম প্রখ্যাত জলি কাউল এবং রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মহাশয়কে। অবশ্য জনসংযোগে আমি প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম আগেই। সেই সঙ্গে ঝুলিতে খবর-কাগুজে অভিজ্ঞতা।
তহুন জেবনডা বেশ জুত লাগতে আছে। আকাঙ্খার গূঢ় প্রশ্রয়ে এটা যেন বিগত বিস্মৃত নিজেকে বতর্মান অস্তিত্বের কাছে ক্ষণিকের আত্মসমর্পণ। জানি,ধ্রুবতার আশ্লেষ মাখানো হলেও কালতত্ত্ব বড়ই কুটিল। কালের বর্জ্য সাফ করে দেয় মহাকাল। এই আছে। এই নেই। একবার শিশুকালে দৌড় প্রতিযোগিতায় কাঁদতে কাঁদতে প্রথম হয়েছিলাম পেছন থেকে একজনের ধাক্কা খেয়ে। এবার তো নিজেই নিজেকে ধাক্কা মেরেছি।

পানসে আবেষ্টনী ডিঙিয়ে পাঁচতারা হোটেল আর অভিজাত ক্লাবে সন্ধে কাটাতে কাটাতে সাহিত্য থেকে প্রায় নির্বাসিত হলাম।তখন লিখতে হচ্ছে বিজ্ঞাপনের কপি কিংবা প্রেসরিলিজ। সম্পাদনা করছি কর্পোরেট হাউস জার্নাল। তখন কত এমএলএ,এমপি আর মন্ত্রীর সঙ্গে গাল ঘষাঘষি।রাইটার্স বিল্ডিং-এ অ্যপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই শুধুমাত্র নক করে আমলাদের ঘরে ঢুকছি।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সন্ধিৎসা,দীপটা শেষমেষ বড় অফিসার বনে গেল। কবি তুষার চৌধুরির কৌতূহল,ও কী এখন ছোটা ব্রিস্টল বা অলিপাবে যায়? পাগলা বাবার মাজারে গাঁজা খায়?
সেই আহ্লাদী ও ঢলোঢলো চওড়া রাস্তায় অবাক লাগে নিজের সুটেড-বুটেড বদল দেখে। তবু সাহিত্য বিচ্ছেদের আভাস,অনুভবে গাঢ় হয়ে উঠলেও পরিবর্তিত সত্তায় লেখালিখির স্বভাবটা স্বমূলে থেকে গিয়েছিল। সাহিত্য-বিদায়ক্ষণের আক্ষেপ কাটিয়ে সানন্দা পত্রিকায় প্রচ্ছদ নিবন্ধ এবং “দি স্টেটসম্যান” ও অমৃতবাজার পত্রিকায় উত্তর সম্পাদকীয় লিখতাম ব্যস্ততার মধ্যেও। অফিস সামলে দিতেন আমার আপ্ত সহায়ক বাচিক শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।বিজ্ঞাপনের জন্য ধরনা দিতেন বহু লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক। আমি নীতিগত ভাবে সেই সব পত্রিকায় কখনও লিখতাম না। সহকারী দেবযানী মিত্রকে বলা ছিল আমাকে কেউ যেন বিরক্ত না করে। চেম্বারে লাল আলো জ্বেলে পেগ দুয়েক পান করে সৃষ্টি হত দর্শনায়িত বোধের। হৃদয় তবু আরাম পেতনা। আশির দশক আমাকে ভোগবাদের ব্যাপক আয়োজনে উন্নত জীবনমান ও অর্থনৈতিক থিতু করলেও কর্পোরেট দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়নি।

(চলবে)

RELATED ARTICLES

Most Popular