✍️কলমে: দীপ মুখোপাধ্যায়
(পর্ব–৭)
যৌবনকালে উড়ে বেড়ায় কত সৃষ্টিশীল কাহিনী। ঘুরে বেড়ায় বিভিন্নচর্চার না লেখা ইতিবৃত্তান্ত। সস্তা নেশার এক মুক্ত সাংস্কৃতিক আড্ডাপীঠ, বাংলা ঢুকুঢুকুর শ্রীক্ষেত্রে,সময়ক্ষেপণ করা মানে পদযুগল টলটলায়মান। ভেসে আসবে তন্দ্রাঘন দেশি মদের গন্ধ। ধোঁয়া,ধুলো আর পায়ের তলার শালপাতা ডিঙিয়ে টিনের চালের নিচে শুধু পরিবৃত হয়ে বসে পড়া।টিনের ফুটো দিয়ে গলে গলে তখন চিরকি কাটবে হলুদ আলোকবিন্দু। টাপুর- টুপুর বৃষ্টিতে যেন বেজে উঠবে শিবকুমার শর্মার ধ্রুপদী সন্তুর। চোখ বুজে আসবে চুমুকের চমকে। সাদাকালো রঙিন হয়ে উঠবেই। যেন এক কল্পজগত। কিশোরবেলা থেকে কলেজস্ট্রিট অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগের কারণে অনেকের লেজুড় হয়ে বুকের দুরুদুরুপনা সামলে আদরের ঠেক খালাসিটোলায় গিয়েছি। উত্তরণের প্রয়াসে ফাইল থেকে মদোন্নতি হয়েছে বোতলে। দুঃখ কষ্ট আর যন্ত্রণা যেন উবে যেত দু-পাত্তর গিললেই।অরসিক কী এই কথা বুঝবে? বুঝত তুষার রায় থেকে তুষার চৌধুরি। অনন্য থেকে অমিতাভ দাশগুপ্ত।
আরও কত হাসিমুখ যে আউট অফ ফোকাস হয়ে গিয়েছে সেই হিসেব রাখা কষ্টকর। তাঁরা যেন আজও আমার কাছে স্বমহিমায় জাগ্রত। এখনো অনর্গল আবৃত্তি করে চলে ভেটকি। গান ধরেন দীপক মজুমদার। আমরা বালখিল্লরা টেবিল চাপড়ে শুধু তাল ঠুকি। হুজ্জুতি আর গ্যাঞ্জামের মধ্যেই অব্যাহত থাকে মতামতের আদান-প্রদান ও আন্তরিক সাহিত্যচর্চা। কেটির অস্তিত্ব একটা বিশাল জায়গা জুড়ে। মদ্যপানজনিত অতিচেতনায় জীবনের বৃহত্তর যোগগুলো বেশ সহজ হয়ে আসে। সময়ের বাঁকে জেগে ওঠে নতুন প্রযুক্তি ও বিচারের স্ট্রাটোস্ফিয়ার।আমি কেটির কোনও গোষ্ঠীভুক্ত না হলেও অনেকের সঙ্গেই সঙ্গত করেছি। একটি টেবিলে কবি মলয় সিংহ, গল্পকার দেবাশীষ দাস সাংবাদিক সুভাষ মৈত্ররা আড্ডা মারতেন। ওদের চেতনালোকের বয়ান কিংবা অন্তস্বরের বহুমাত্রিকতায় আবিষ্ট হতাম নিবিড়ভাবে। অন্তর্নিহিত গুরুতায় আড্ডার ভাব যতই গম্ভীর হোকনা কেন আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে ভাসিয়ে দিতেন জেঠু, কুমারদা,লালটু সিনহা অথবা ফরাসি বিশেষজ্ঞ নারায়নদা।শুকনো নেশার পর জলপথে আসতেন তিনি। এরা কবি না হয়েও কেউ দ্যুতিহীন ছিলেন না। কথাবার্তায় একটা অন্তর্গত বিমূর্ত রূপ অনুভূত হত।
তূরীয় মুহূর্তে নারায়নদা বলতেন,তোরা কবিতাকে ভদ্রলোকের বৈঠকখানা থেকে খালাসিটোলায় নামিয়ে আন। রাঁবোর ইলুমিনেশনস-এর মতো ভাষার শরীরকে তছনছ করে দে।ব্যোদলেয়ারও নিকষ কালো অন্ধকার আর পাপের কথাই বলতে চেয়েছেন। আণবিক বোমার মতো ফাটিয়ে দে আতুপুতু কবিতার এফিডিসগুলো।নিজেকে অন্য কেউ করে তোলাটাই কবি হয়ে ওঠা। তখন আমি বুঝে কিংবা না-বুঝে নিজের মুগ্ধতা ও সংবেদনশীলতাকেই প্রশ্রয় দিতাম। বুঁদ থাকতাম মদ্যজনিত মায়া ব্যঞ্জনে। এখনও চোখে ভেসে ওঠে কাউন্টার এর পিছনে চশমা চোখে অনিলদার রহস্যময় হাসি মুখ। আমার মত অন্তর্লীন মদ্যপায়ী চাট আকাঙ্ক্ষী হয়ে খোঁজ পেয়েছিল মিলনের আস্বাদ্য মুরগির ছাঁট কিংবা সুরিন্দরের চমকপ্রদ চানাচুর মাখার অনুষঙ্গসমূহ। কল্পনা-প্রতিভা ও পরজীবী জীবনবোধে সক্রিয় রাজা দা কে চিনেছিলাম কেটিতেই। উদ্দীপনাতরঙ্গে মিশে যেতেন কথনপটু স্বপন ঠাকুর কিংবা সেতারবাদক ও কৌতুক হাস্যরসিক অমলজ্যোতি চৌধুরী। মনে মনে দৃষ্টান্ত স্থাপনের প্রচেষ্ঠা করলেও এরা স্বতন্ত্র মাত্রায় উন্নীত হতে পারেননি বরং অপ্রাপ্তির হতাশায় কেটির সনিষ্ট যাত্রিক হিসেবেই জানাতেন তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি।
এভাবেই কিছু কিছু চরিত্র চলে যায় গন্তব্যহীন যাত্রাপথে এক মদ্যমিথের মুগ্ধতা ও প্রবাহমানতায়।
আমরা আবার কাছাকাছি আসি। ইংরেজি মাধ্যম শুঁড়িখানায় দেখা হলে একে অপরের খোঁজ করি।মুখের দিকে তাকাই।তা সে যতই ভঙ্গুর হোক না কেন।চকিতে উদ্ভাসিত হয় সমুদ্র সমান ভালোবাসা।পর্যবেক্ষণ থেকে ঝরে পড়ে গ্রাহ্য,আস্বাদনযোগ্য সময়ের সংজ্ঞা।হাহাকার জারিয়ে তোলে আমাদের সম্পর্ক। পারদ লাঞ্ছিত বাবু সমাজের কিছু বালখিল্য সাংস্কৃতিক বরকন্দাজেরা অবশ্য এত কিছু বুঝবেন না। তাঁদের খানদানী চাঁদ-পিরিচে ভাসুক পেগ সিস্টেমের ইংরেজি মাধ্যম।আমার মতো এমন বালুকাহৃদয় আহ্লাদী নাগররাই সরকারি সিল মারা পঞ্চাশ-শক্তি পান করে আত্মযুদ্ধে বেছানো দীর্ঘ মদযাত্রায় অস্তিত্ব উদ্বোধিত আত্মবিচারে অফুরন্ত জীবন খুঁজতে থাকি। এটাই ছিল বাংলা মদ আর আমাদের যৌবনের পরিপূরণ খেলা।
(চলবে)