✍️কলমে: দীপ মুখোপাধ্যায়
(পর্ব-৩)
অনিশ্চিতের এক জটিল আবর্তে,নাগরিক অহমিকায়,তখন শিক্ষানবিস সাংবাদিক হয়ে কাজে ঢুকে পড়েছি দৈনিক বসুমতী সংবাদপত্রে।বেতন যৎসামান্য। তাই অর্থ রোজগারের গাঢ় আকুলতা আমাকে অধৈর্য করে তুলত। অতএব লেখালিখিটাকেই মূলধন ঠাউরে শ্যাস-ম্যাস নাইমে পড়লাম অক্ষরবিক্রির উঞ্ছবৃত্তিতে। যে বাবুরা পয়সা দেবে সেখানেই লিখব। দৈনিক বসুমতীর সম্পাদক বাধা দেননি অন্য পত্রিকায় লিখতে। নিয়মিত ফিচার ছাপা হতে লাগল,আনন্দবাজার পত্রিকায়।আকাশবাণীতে মাসে একটি করে কথিকা। অপেক্ষায় থাকতাম কবে বন্যা হবে কিংবা খরায় জেরবার হবে মানুষজন। এইসব নিয়েই তো লিখতে হবে। এরমধ্যে আনন্দলোক ম্যাগাজিনে সেবাব্রত গুপ্তের আনুকূল্যে বেরুল আমার প্রচ্ছদ নিবন্ধ,”সত্যজিৎ চলচ্চিত্র:শব্দ ও সংগীত”। নিজেকে বৃহৎ ফিল্মবাফ ঠাউরে নিলাম।সিনেমার ওপেনিং শট দেখেই বোদ্ধার মতো বলে দিতাম অ্যারিফ্লেক্স না মিচেল ক্যামেরায় তোলা হয়েছে। ঠোঁটের ডগায় তখন বার্গম্যান,ত্রুফো কিংবা আন্তোনিয়োনি। স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললাম পরিচালক অঞ্জন দাশ-এর একটি স্বল্পদৈর্ঘ সিনেমার। ছবিটি অবশ্যই আলোর মুখ দেখেনি। ক্রমে নির্ধারিত নিয়মে এবং আর্থিক অসচ্ছলতার কাতরতায় আবার সাহিত্য-সংবাদ সেবায় প্রত্যাগমন করলাম।
এরমধ্যে “দি স্টেটসম্যান”খবরের কাগজ মুক্তমেলায় পঠিত আমার একটি কড়ামিঠে ছড়া ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিল। নিজের সামাজিক ও ব্যক্তিক প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে আমি তখন তৎপর।মুক্তমেলায় সমরেশ বসু মন্দিরা বাজিয়ে গান গাইতেন। আসর মাত করে দিতেন সুনীল,শক্তি,বিনয় মজুমদার কিংবা বাচিক শিল্পী নীলাদ্রিশেখর বসু।তুষার রায়ের ব্যাঙ্গ ছড়া যেন হুল ফোটাত চামড়ায়।গড়ের মাঠের অপরপ্রান্তে তখন বাদল সরকারের শতাব্দী নাট্যগোষ্ঠী রগড় জমাচ্ছে। আমিও সেই আবহে অবগাহন করি মিত্রসুখ সম্ভোগে।খরচ-খর্চাডাই তহুন পেরথম সমস্যা। পকেটে টান ধরতে বহুবাজারে বন্ধকী কারবারির কাছে ঘড়ি বাঁধা রাখতাম। অবশ্য মাসপয়লা বেতন পেতেই ওটা ছাড়িয়ে নিতাম। আমার নিরীহ মুখের দিকে তাকিয়ে সেই কারবারি বলেছিলেন, আপনাকে ভাই আর ঘড়িটা জমা রাখতে হবেনা। এমনিই টাকা নিয়ে যেতে পারেন। জানি,আপনার থেকে টাকাটা মার যাবে না।
তবে জনৈক কাবলিওয়ালা আমার সততা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা পোষণ করতেন না। একবার সশরীরে আমার খোঁজে হানা দিয়েছিলেন বসুমতীর নিউজরুমে। মাননীয় এডিটারের কানে কথাটা যেতেই আমায় ডেকে কড়া ধমক দিয়েছিলেন,লজ্জা করে না?ভদ্রলোকের ছেলে না আপনি? আপনার খোঁজে অপিসে কাবলিওয়ালা ঢুকছে! ছি-ছি। এসব চলবে না আমাদের কাগজে।
আমি হাজার দুয়েক ধার নিয়েছিলাম ব্যাঙ্ক অফ আফগানিস্তানের থেকে। লোকটা সত্যিই এসেছিল সুদ চাইতে। তবু অবস্থা সামাল দিতে এঁড়ে তক্ক জুড়লাম,যা ভাবছেন তা নয় স্যর। “কলকাতার কাবলিওয়ালা” শিররোনামে একটা নিবন্ধ লেখার জন্য লোকটাকে ডেকেছিলাম। তাই বোধহয় আমায় খুঁজছিল। এডিটর সাহেব ভ্যাবলা মুখে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন।
আপনি মুখোমুখি হলে হয়তো বলে উঠতেন,ওরে বাহুতরা ছ্যামড়া। মুরুব্বিগো লগে বেয়াদবি করাডা ছাড়ো।ইহকাল পরকাল ঝরঝরে অইবে তর। মর্ মর্।মোর ঠেহাডা কী?
(ক্রমশ প্রকাশ্য)