শশাঙ্ক প্রধান: একবার খবর এসেছিল পিংলার ওপর দিয়েই যাবে ঘূর্ণিঝড় যশ। সেইমত প্রস্তুতি শুরুও হয়ে গিয়েছিল প্রশাসনের কিন্তু শেষ মুহূর্তে জানা যায় ঝড় যাবে ওড়িশার ওপর দিয়েই। শেষ অবধি ঝড় যায় ওড়িশার ওপর দিয়েই, বেঁচে যায় পিংলা কিন্তু ঝড়ের এই মাতামাতি আতঙ্কের মধ্যেই যে খবরটা চাপা পড়ে গেছে তাহল যশ না হলেও অন্য একটি ঘূর্ণিঝড় চলে গেছে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার হান্দোল গ্রামের ওপর দিয়ে আর সেই ঝড় মুছে দিয়ে গেছে এক তরুণী গৃহবধূর মাথার সিঁদুর। মাত্র দেড় মাস আগে পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়া ওই গৃহবধূ ওই শিশু আর আগের ৫বছরের শিশুকন্যা নিয়ে অথৈ সাগরে। তাঁর স্বামীযে আগের দিনও বলেছিল বাড়ি ফিরেই ছেলের সাথে খুব মজা করবে!
২৬ তারিখ বঙ্গপোসাগর থেকে ওড়িশার ধামাসে আছড়ে পড়েছিল যশ আর তার ঠিক দশদিন আগে আরব সাগরে সৃষ্ট তাওত আছড়ে পড়ে মহারাষ্ট্রের উপকূলে। ১৬ই মে মধ্যরাতে সেই মারাত্মক ঝড়ের কবলে পড়েই উপকূল থেকে প্রায় ১০০কিমি দূরত্বে সমুদ্র গর্ভে থাকা জাহাজ পি-৩০৫ (P-305 barge)। ২৬১জন যাত্রী ও কর্মী নিয়ে থাকা এই জাহাজটি অয়েল এ্যন্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশন (ONGC)র সহকারি হিসাবে কাজ করছিল। এই জাহাজেই ছিলেন পিংলার হান্দোল গ্রামের ৩৭বছরের শ্রীকান্ত খাটুয়া। মুম্বাইতে ONGC তৈল উত্তোলন সংস্থার ওই জাহাজ পি-৩০৫ বার্জের রাঁধুনি হিসেবে কর্মরত ছিলেন শ্রীকান্ত। গত ১০ বছর ধরেই এই কাজ করছিল শ্রীকান্ত। ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় তাওতের কবলে পড়ে পি-৩০৫ বার্জটি, ডুবে যায়। পরের দিন নৌবাহিনী উদ্ধার কার্যে নেমে ২২টি মৃতদেহ সহ অনেককেই জীবন্ত উদ্ধারে সমর্থ হলেও খোঁজ মেলেনি শ্রীকান্তের।
২৩শে মে সমুদ্র সৈকতের পাশে একটি দেহটি পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় এলাকার মানুষেরা। খবর পেয়ে দেহটি উদ্ধার করে মহারাষ্ট্রের পালভর জেলার বাহানা থানা। শ্রীকান্তের পকেটে থাকা পরিচয় পত্র ও পাসপোর্ট থেকে পরিচয় উদ্ধার করে থানার তরফ থেকে খবর দেওয়া হয় পরিবারের কাছে। পরিবারের তরফে গত ২৪ শে মে মহারাস্ট্রের পালভর জেলার বাহানা থানায় গিয়ে শ্রীকান্তের দেহটি সনাক্ত করেন দাদা সুশান্ত। বৃহস্পতিবার, যশ আছড়ে পড়ার ঠিক পরের দিনই পরিবারের তরফে শ্রীকান্তের শ্রাদ্ধাঅনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। ঘটনাটি মানুষ জানতেই পারেনি কারন তখন মানুষ যশের আতঙ্কে ছিল।
শ্রীকান্তের স্ত্রী জানিয়েছেন রবিবার রাত ১১টায় শেষ কথা হয়েছিল ফোনেই। পরের দিন দুপুরে ফোন করার কথা ছিল তাঁর কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি। সারাদিন উদ্বিগ্ন হয়ে কাটানোর পরই খবর আসে ছ’ভাগের পাঁচভাগই ডুবে গিয়েছে, ৫৫জন নিখোঁজের মধ্যে শ্রীকান্তও রয়েছে। এরপরই মুম্বাই ছুটে যান শ্রীকান্তের দাদা সুশান্ত। শ্রীকান্তের বাবা কার্তিক বাবু বলেন, ‘নিজের জীবন থাকতে থাকতে ছেলের জীবন চলে গেল ভাবতে পারছিনা।এই দিন দেখতে হবে কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। যশ না এলে জানতে পারতাম না তাওত কতটা যন্ত্রণাদায়ক ছিল, ঐদিন ছেলে কতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে ছিল।’
স্ত্রী আসন্নপ্রসবা জানার পরই কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলেন শ্রীকান্ত। সন্তানের জন্মের পরেই চলে যান কাজে। যাওয়ার সময় বলে যান, ব্যাটা একটু শক্তপোক্ত হোক, এসে খুব খেলব ওর সঙ্গে। রবিবার শেষ ফোনে স্ত্রীকে ফের সেই কথাই বলেছিলেন। কিন্তু সেই আশা অধরাই থেকে গেল। শ্রীকান্তের কাকা দীনেশ খাটুয়া বলেন, ” এই গ্রামে অনেকেই জাহাজে কাজ করে। অনেকদিন কাজ করার জন্য শ্রীকান্ত বড় জাহাজে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল। তাকে হারিয়ে পরিবারটির কী হবে? কি করবে ওই শিশু দুটো?” গোটা গ্রাম এখনও শোকস্তব্ধ।