Homeরাজ্যনেই হাসপাতাল কর্মী ! ঠায় দাঁড়িয়ে আ্যম্বুলেন্স চালক, মোবাইলে ভিডিও করছে মানুষ,...

নেই হাসপাতাল কর্মী ! ঠায় দাঁড়িয়ে আ্যম্বুলেন্স চালক, মোবাইলে ভিডিও করছে মানুষ, স্ত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন মারা যাচ্ছেন স্বামী

তিতলী সেনগুপ্ত :সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে একজন অসুস্থ, অক্ষম, রোগগ্রস্ত মানুষকে আ্যম্বুলেন্সে তোলার চেষ্টা করছেন স্ত্রী। হাসপাতাল চত্বরে আ্যম্বুলেন্স লাগিয়ে দিয়ে পিপিপি কিটস পরে দুরে দাঁড়িয়ে আ্যম্বুলেন্স চালক। আ্যম্বুলেন্স চালু অবস্থায় রয়েছে। রোগী উঠলেই আ্যম্বুলেন্স ছেড়ে দেওয়া হবে। বনগাঁ হাসপাতাল থেকে রোগী যাবে কোভিড হাসপাতালে। তখনও জানাই যায়নি তাঁর করোনা হয়েছে কিনা! শ্বাস কষ্ট হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে তাঁর করোনা হয়েছে তাই সরানো হচ্ছে কলকাতার কোনও হাসপাতালে। কিন্তু রোগীর হাঁটার ক্ষমতা নেই, আ্যম্বুলেন্স ঘেঁষে বসে পড়েছেন মেঝে তে। তাঁর স্ত্রী তাঁকে তোলার চেষ্টা করছেন কিন্তু পেরে উঠছেন না। রোগী চেষ্টা করছেন আ্যম্বুলেন্স ধরে উঠে দাঁড়ানোর কিন্তু ক্ষমতায় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। মানুষ দুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, কেউ মোবাইলে ভিডিও করছেন পরে ফেসবুকে ছাড়বেন বলে। কেউ দূর থেকেই বলছে, মনে জোর নিয়ে উঠে পড় কাকা। স্ত্রী সবার কাছে কাকুতি মিনতি করছেন, একটি বার ধরে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছেনা। এরপর মেঝেতেই লুটিয়ে পড়ে মারা যাচ্ছেন মানুষটি। এই ঘটনার দৃশ্য রচিত হল বনগাঁ জীবন রতন মহকুমা হাসপাতালে। সাকিন, পশ্চিমবঙ্গ।

জানা গেছে প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে শনিবার বিকেলে বনগাঁ জীবন রতন ধর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল বছর ৬৫-র মাধব নারায়ণ দত্তকে৷ বনগাঁ নিউমার্কেটে তাঁর মুদির দোকান রয়েছে। করোনা পরীক্ষা না করেই চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে ধরে নেন ওই ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত। সে মত অক্সিজেনও দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু রাত বাড়তে থাকলে ক্রমশ তাঁর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রাত ৯ টা নাগাদ হাসপাতালের তরফে তাঁকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। হাসপাতালের কথা মত রোগীকে কলকাতায় নিয়ে যেতে প্রস্তুত স্ত্রী আলপনা দেবী। কিন্তু মাধববাবুর শারীরিক অবস্থা এতটাই মারত্মক যে উঠে দাঁড়াতেই পারছেন না। সেসময় স্ট্রেচারে করে অসুস্থ মাধববাবুকে অন্তত অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর স্ত্রী হাসপাতালের কর্মীদের বারবার অনুরোধ কর‍তে থাকেন। কিন্তু কেউ সাহায্য করেনি, বরং স্বাস্থ্যকর্মীরা অবহেলার সুরে বলেন, “করোনা রোগীকে ছোঁয়া যাবে না। আপনি নিজেই নিয়ে যান।”

এভাবে ঘণ্টাখানেক কাটার পর রাত ১০ টা নাগাদ স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই কোনওরকমে মাধববাবুকে টেনে হাসপাতালের চাতাল পর্যন্ত আনেন স্ত্রী আলপনা দেবী৷ কিন্তু চাতাল পর্যন্ত আসলেও আর উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই ওই ব্যক্তির৷ স্ত্রী বারংবার চেষ্টা করছে স্বামীকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হচ্ছে না৷ রাত বাড়ার সাথে সাথে হাসপাতালের বাইরেটাও অনেকটাই ফাঁকা। কিন্তু তবুও জনা কয়েক লোক দেখা যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সেই বিরল মূহুর্ত ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যাস্ত। যাতে সেই ভিডিও আবেগমাখা ক্যাপশনে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে আলপনা দেবী স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে বারংবার সকলের কাছে কাকুতিমিনতি করলেও সংক্রমণ ছড়ানোর ভয়ে সামান্য অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়ার জন্যও কেউ এগিয়ে আসেননি। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স চালকও কানে ফোন নিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকেন। কিন্তু তবুও ওই মহিলার এমন অসহায় অবস্থা দেখেও তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি৷

এভাবেই কেটে গেল আরও একঘন্টা। রাত ১১ টা, মাধববাবু ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছেন। পাশ থেকে কয়েকজনকে বলতে শোনা গেল, “কাকু, অ্যাম্বুলেন্সটা ধরে উঠুন।” কিন্তু সে শক্তি মাধববাবুর আর কোথায়! দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাঁর অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক, তাড়াতাড়ি চিকিৎসা না করলে অবস্থার অবনতি হতে পারে। এরমধ্যেই কিছুটা দূরেই একজন পিপিই পড়া স্বাস্থ্যকর্মীকে দেখা গেল। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন। কিন্তু তার থেকে কয়েক পা দূরেই যে এমন একটা মর্মান্তিক কান্ড ঘটে চলেছে তা প্রথমে দেখেও না দেখার ভান করলেন। এর প্রায় আধঘণ্টা পর যখন একেবারেই শরীর ছেড়ে দিয়েছেন মাধববাবু, সেসময় ওই পিপিই পড়া ব্যাক্তি সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ৷ দীর্ঘক্ষণ প্রবল শ্বাসকষ্টে ভুগে অবশেষে চাতালের উপর বসেই মারা যান মাধববাবু। মাধববাবুর এই মর্মান্তিক পরিণতি প্রকাশ্যে আসতে স্তব্ধ গোটা রাজ্য৷

বনগাঁ জীবন রতন ধর হাসপাতালের এই চরম অমানবিক ঘটনা মূহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। হাসপাতাল কর্মীদের আচরণে ক্ষুব্ধ হন সাধারণ মানুষ। এরপর সোমবার বনগাঁ মহকুমা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলার আগে ও পড়ে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। হাসপাতালের সুপার শংকর প্রসাদ মাহাতো বলেন, “তিনজনের কমিটি তৈরি করে পুরো রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। কেউ দোষী হলে অবশ্যই তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে।” যদিও করোনা পরীক্ষা করানোই হয়নি মাধববাবুর। তবুও তাঁর মৃত্যুর পর পরিবারের তরফে হাসপাতাল সুপারের কাছে সরকারিভাবে সৎকারের আবেদন জানানো হয়। গোটা রাজ্য যখন করোনা সংক্রমণে ধুঁকছে সেসময় বনগাঁ জীবনরতন ধর মহকুমা হাসপাতালের এমন অমানবিক আচরণে ক্ষুব্ধ জেলার স্বাস্থ্য কর্তারা। ইতিমধ্যেই এই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছেন উত্তর ২৪ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস কুমার রায়। তিনি বলেছেন, ‘‘অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। তদন্ত চলছে। যাদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

RELATED ARTICLES

Most Popular