নিজস্ব সংবাদদাতা: চার দফার লকডাউন চলছে দেশে আর সেই তার মধ্যেই একের পর এক পরিযায়ী শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু আর হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখেছে দেশ কিন্তু সে সবকেই বোধহয় ছড়িয়ে গেল লকডাউনের ৬৪ দিনের মাথায় বিহারের মজফ্ফরপুর রেল স্টেশনের এক মর্মস্পর্শী দৃশ্য যেখানে দেখা গেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকা এক মহিলার পোশাক ধরে টানাটানি করছে তার দুধের শিশুটি। মা-কে ‘ঘুম’ থেকে তোলার চেষ্টা করছে বাড়ি যাওয়ার জন্য আবার কখনও মায়ের ঘুম ভাঙলে আপনা থেকেই উঠবে ভেবে আপন মনে খেলেই চলেছে। বেচারা জানেই না যে তার মা শেষবারের মত ঘুমিয়ে পড়েছে আর কোনও দিনই জাগবেনা। কিন্তু ছেলেটি হাল ছাড়ছেনা মাকে মাঝে মধ্যে ডেকেই চলেছে কখনও বাড়ি যাওয়ার জন্য কখনও আবার তার সঙ্গে খেলার জন্য। কিন্তু কোনও সাড়া নেই মায়ের। পাশেই পড়ে রয়েছে লাগেজ।
বিহারের মুজফ্ফরপুর স্টেশনের এই মর্মান্তিক ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। বুধবারই এই ভিডিওটি প্রকাশ্যে এসেছে আর এই ভিডিওটিকেই এই সময়কালের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ভিডিও বলা হচ্ছে যে সময়ে লকডাউনের জন্য কর্মহীন হয়ে পড়া নিঃস্ব রিক্ত ক্ষুদা কাতর লাখো লাখো শ্রমিকের ঘরে ফেরা শুরু হয়েছে। তরুণীর পরিবার জানিয়েছে, শনিবার আমদাবাদ থেকে বিহারগামী ‘শ্রমিক স্পেশ্যাল’ ট্রেনে উঠেছিলেন। জল ও খাবারের অভাবে ট্রেনেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সোমবার মুজফ্ফরপুরে ট্রেন ঢোকার কিছুটা আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। স্টেশনেই মহিলার দেহ রাখা হয়।
পরিবারের দাবি, অত্যধিক গরম, খিদে এবং ডিহাইড্রেশনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ঠিক এই স্টেশনেই একটি দুবছরের শিশুরও অত্যধিক গরমে এবং ক্ষুদাকাতর হয়ে মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে।
এই ভিডিও সামনে আসার পরই কংগ্রেসের সোশ্যাল মিডিয়ার জাতীয় কো-অর্ডিনেটার গৌরব পানধি এই ঘটনার জন্য রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলকে সরাসরি দায়ি করে বলেছেন, ‘এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক মৃত্যু এবং এরজন্য আপনি এবং আপনার সরকারই দায়ি। আপনাদের ধিক্কার জানাই।’
বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের অধিনায়ক তেজস্বী যাদবের সহকারী সঞ্জয় যাদব প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ এই শিশুটি জানেই না যে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছে যে মা চারদিন ধরে কোনও খাবার ছাড়াই গুজরাট থেকে ট্রেন সফর করে এসেছে। এরপর যদি বিরোধীরা যদি অস্বস্তিকর প্রশ্ন উত্থাপন করে তাতে দোষের কি রয়েছে?’
যদিও পুরোপুরি ভিন্ন তত্ত্ব খাড়া করেছে রেল। সংবাদসংস্থা পিটিআইয়ের খবর অনুযায়ী, তরুণীর দেওরকে উদ্ধৃত করে মুজফ্ফরপুরে আরপিএফের ডেপুটি সুপার রমাকান্ত উপাধ্যায় বলেছেন, ‘আমার বৌদি হঠাৎ ট্রেনে মারা যান। খাবার বা জল পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কোনও সমস্যায় পড়িনি।’ যদিও দেওরের নাম প্রকাশ করেননি ওই আধিকারিক।
একইসঙ্গে মৃতার দেওরকে উদ্ধৃত করে রমাকান্ত জানান, ‘গত এক বছর ধরে আমদাবাদে তরুণীর কিছু চিকিৎসা চলছিল। সোমবার পরিবারের থেকে খবর পেয়ে পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েছে। রমাকান্ত এও বলেন, ‘উনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন।’ তবে কী কারণে মহিলার মৃত্যু হয়েছে, তা জানাতে চাননি রমাকান্ত। অনেক জোরাজুরির পর তাঁর মন্তব্য, ‘শুধুমাত্র চিকিৎসকরা বলতে পারবেন।’
উল্লেখ্য মার্চ মাসে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই হেঁটে, সাইকেলে বা নানা ভাবে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফেরা শুরু করেছেন। কখনও কখনও খালি পেটেই হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটছেন তাঁরা আর এই পথ হাঁটতে গিয়ে এখনও অবধি ১৭০ জনেরও বেশি পরিযায়ীর মৃত্যু হয়েছে। তবে সব মৃত্যুকেই বোধহয় ছাপিয়ে গেছে এই তরুনীর মৃত্যুর দৃশ্য।