অনির্বান ইসলাম: এক জনের ছেলের বয়স ৪২ বছর, অন্যজনের মেয়ের বয়স ৩৮। দুজনেরই বাড়ি মেদিনীপুর শহরে। একজনের চিড়িমারসাই অন্যজনের হাতারমাঠ! একজন অবসর নিয়েছেন গতবছরই যেবার শহিদ প্রদ্যোৎ স্মৃতি ভবনে একটি অনুষ্ঠানে শেষবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন। সেদিন ৬০বছর বয়সে দেখে এসেছিলেন তাঁকে। অন্যজন শহরেরই নামি একটি স্কুলের দিদিমণি। অবসর নিতে মাত্র ২ বছর বাকি। সালটা ১৯৭৪ যখন দুজনেই মাঝে মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতেন মেদিনীপুর রেল স্টেশনের ১নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠে যাওয়া ওভার ব্রিজটার সেই মাঝের পাটাতনে যেখানে অনুরাধার কাছে ফিরে এসেছিল শ্যাম কিংবা অপর্ণা সেনের কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়!
১৯৭২ সালের ‘বসন্ত বিলাপ’ শ্যুটিংয়ের ২বছর পরের ঘটনা এটা, যখন কলেজ পড়ুয়া সেই যুবক-যুবতীর মতই আরও কত প্রেমিক প্রেমিকা পরের প্রায় ১০বছর ধরেই ওভার ব্রিজের ঠিক ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্ততঃ একটি বার একে অপরের হাত ছুঁয়ে গেছে! তা নাহলে নাকি প্রেম সম্পূর্ণই হতনা।
“তখন প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটার বালাই ছিলনা। প্ল্যাটফর্মে যাত্রীবাহী ট্রেন না ঢুকলে টিকিট চেকার থাকত না। কলেজ কাট মেরে রাঙামাটি লেবেল ক্রসিংয়ের পাশ দিয়ে ঢুকে যেতাম ওভারব্রিজটার কাছে। তারপর তিনি আসতেন দু’পাশের বেণী দুলিয়ে। একা একা আসতে পারতেন না অবশ্য সঙ্গে একজন বান্ধবীকে নিয়ে আসতেন।”
বয়স্ক মানুষ, বাকি টুকু শুনতে নেই। কিন্তু কথা বলতে বলতে তাঁর রাঙা হয়ে যাওয়া মুখ বেশ বুঝিয়ে দেয় সেই বয়সের রোমাঞ্চ আজও অনুভব করেন তিনি। “মেদিনীপুর প্ল্যাটফর্মে যদিও বসন্ত বিলাপের শেষ দৃশ্যে মিলন ছিল কিন্তু আমাদের সেটি হলনা বুঝলে! তার বাবা মারা যেতে দাদারা বিয়ে দিয়ে দিল। আমি তখন আকাট বেকার। তার বিয়ে হল এই শহরেই। বিয়ের পর এম.এ করে একদিন শুনলাম চাকরিও করছে সে। আমিও ততদিনে চাকরি পেয়ে গেছি।”
পরে আর দেখা হয়নি কোনোও দিন? মানুষটি হাসলেন, ‘হওয়ার কোনোও সম্ভবনা ছিলনা বুঝলে। আমি চাকরি পেলাম রাইটার্স মানে মহাকরণে। পুরুলিয়া ধরে যেতাম আর পুরুলিয়াতেই ফিরতাম। মেদিনীপুর শহরটাই হারিয়ে গেল চাকরির ঠেলায়। শনি-রবি ছুটি থাকলেও শহরে বেরুতামনা বড় একটা। খালি ওই ওভার ব্রিজটার কাছে আসলে বুকটা কেমন করত। তবুও একবার দেখা হয়ে গেল! বছর ২০ বছর আগের এক শীতকাল। রাজধানী এক্সপ্রেসে সপরিবার দিল্লি যাচ্ছি। ট্রেনটি আসছে পুরী থেকে। সে বোধহয় পুরী থেকেই ফিরল। সঙ্গে তাঁরও পরিবার। আমি স্পষ্ট দেখেছি সেই ওভার ব্রিজটার কাছে একটু যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল সে। তারপর ট্রলি ব্যাগটা টেনে হনহন করে চলে গেল আমার পাশটি দিয়ে। প্রায় ২২/২৩ বছর পর সেই দেখা।”
চোখাচোখি হয়েছিল? জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও থমকে গেলাম। ৬১ বছরের বৃদ্ধ মানুষটাকে সে প্রশ্ন করা যায় কিনা তাই ভাবছিলাম। কিন্তু প্রশ্নটা করা হলনা। তিনি বললেন, স্টেশনটা অবিকল ওরকম রেখে দিলে ভাল হত বুঝলে। সব কিছুই কী আধুনিক করা খুব জরুরি?” রবিবার বেলা তিনটে নাগাদ মেদিনীপুর শহরের চিড়িমারসাইতে যখন এই সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম তখন কলকাতায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষ যাত্রার প্রস্তুতি। ভদ্রলোক টিভির রিমোট টিপে সুইচ টা অফ করে বললেন, ‘সব কিছু দেখতে নেই বুঝলে। যেমন দেখতে নেই ভেঙে দেওয়া মহুয়া সিনেমা, চার্চ স্কুলের সামনের ওই ডিভাইডার দেওয়া রাস্তা আর নতুন ফলক লাগানো মেদিনীপুর স্টেশন। একদিন ওই ওভারব্রিজটাও তো বদলে দেবে তোমরা।”