নিজস্ব সংবাদদাতা: মাত্র ৭২ ঘন্টা আগেও শালবনীর কোভিড ওয়ার্ড থেকে জানিয়েছিলেন, ভালো আছি! শুভেচ্ছা উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্যে যাঁরা এই করোনা দুর্দিনে তাঁর পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তারপর শুধুই নীরবতা! সেই নীরবতার মধ্যেই মেদিনীপুর শহর জুড়ে একটাই দীর্ঘশ্বাস আর সে দীর্ঘশ্বাসের নাম মিতালী ত্রিপাঠী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে প্রায়ত হলেন শহরের নাম করা বাচিক শিল্পী মিতালীর। থেমে গেল অনন্ত কথা। কয়েকঘন্টা আগেই শালবনী করোনা হাসপাতাল থেকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে চলে এসেছিলেন তিনি কারন এখানে কোভিড আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছেন তাঁর বাবা এবং স্বামীও। চেয়েছিলেন এখানেই থাকতে, তাঁদের পাশাপাশি কিন্তু থাকতে পারলেন কই? নির্মম করোনা কেড়ে নিল তাঁকে।
ডেবরা থানার মাড়োতলাগামী রাস্তায় পাঁচগেড়িয়া উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা ছিলেন মিতালী ত্রিপাঠী। স্কুল পাঠ্যের তালিম নিয়েছেন মিশন গার্লসের মত নামজাদা স্কুলে। পাশাপাশি ছিলেন বাচিক শিল্পী। আবৃত্তি, শ্রুতিনাটকের পাশাপাশি অনুষ্ঠান সংযোজনা ও সঞ্চালনায় নিপুণ দক্ষতা ছিল তাঁর। শহর এবং শহর ছাড়িয়ে ছিল তাঁর এই শিল্পী পরিচিতি। আর মেদিনীপুর শহরের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেই ছিল তাঁর অমলিন সখ্যতা। তরুণ কবিদের কবিতা নিজের কন্ঠে বসিয়েছেন কতবার। সেই সবার প্রিয় মিতালীদিকে হারিয়ে মেদিনীপুর শহরের সব কথাই যেন থেমে গিয়েছে বৃহস্পতিবার রাত থেকে।
শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী সুদীপ খাঁড়া জানিয়েছেন, “সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বিকাল অবধি জেনেছি মানুষটা ভালো ছিলেন । দুদিন আগেই আমাকে ফোন করে বললেন, আমাকে মেদিনীপুর মহকুমা শাসকের নম্বরটা দাও। আমি শালবনী থেকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে যেতে চাই। ওখানে আমার বাবা, স্বামী ভর্তি রয়েছেন। তারপর এখানে চলে এলেন। ভালই ছিলেন, হঠাৎ কী হয়ে গেল?”
শুধু শিক্ষিকা বা শিল্পী নয়, তাঁর মধ্যে লুকিয়ে ছিল একটি দরদী প্রাণ আর সেই প্রাণ কাঁদত দুঃস্থ মানুষদের জন্য। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য বিজয় পাল বলেন, ‘লকডাউনের সময় সমাজের বিভিন্ন স্তরের শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাঁদের কিছুটা আর্থিক সাহায্য করার লক্ষ্যে আমরা যে কর্মসূচি নিয়ে ছিলাম তাতে ভালো পরিমান সাহায্য করেছিল মিতালী। তাঁর অনেক গুণের পাশাপাশি এই গুনটাও ছিল। এমন একজন মানুষকে হারিয়ে বড়সড় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের।”
মেদিনীপুরের তরুণ কবিদের সংগঠনের অন্যতম সংগঠক নিসর্গ নির্যাস জানালেন, ‘ কত পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল মিতালীদিকে নিয়ে। কিছু কাজ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ও নারী বিষয়ক উপস্থাপনা নিয়ে। বাকি রয়ে গেছে অনেকটাই। এই কদিন আগেও শহরের বসন্ত উৎসবে চুটিয়ে অনুষ্ঠান করলেন। মনে পড়ছে আমাদের তরুণ কবিদের একটি অনুষ্ঠানের কথা। মিতালীদি অসুস্থ। লাঠি ধরে অনুষ্ঠানে উঠলেন তারপর মেতে উঠলেন আমাদের সঙ্গে। একসময় দুত্তোর লাঠির বলে লাঠি ফেলে দিয়ে শুরু করলেন নাচ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই পাথরা গিয়ে কিছু কোরিওগ্রাফি করার কথা ছিল!সব, সব কেমন শূন্য হয়ে গেল।”
চামড়ায় কর্কট রোগ নিয়ে কিছুটা সমস্যায় ছিলেন কিন্তু তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড থেমে থাকেনি। চাকরি জীবন থেকে অবসর নিতে আরও কয়েকটা বছর বাকি ছিল কিন্তু তার আগেই কোভিড জীবন থেকেই অবসর দিয়ে দিল তাঁকে। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-শিক্ষানুরাগী সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে তাঁর দুই মেয়েই নৃত্য জগতের গুনী শিল্পী, মায়ের একান্ত ইচ্ছাতেই মেয়েরা এসেছিল সাংস্কৃতিক জগতে। স্বামী পুলকেশ ত্রিপাঠী অবসরপ্রাপ্ত যশস্বী ইংরেজী শিক্ষক। শেষ খবর পাওয়া অবধি কোরনা নেগেটিভ হয়েছেন পুলকেশ বাবু। মিতালীর বাবাও বর্তমানে স্থিত বলে জানা গেছে। শুধু চলে গেলেন মিতালী, অব্যক্ত যন্ত্রনা সহ শহরকে আরও একটু মৃত্যু দিয়ে গেল করোনা। সবারই প্রশ্ন একটাই, আর কত প্রিয়জন কেড়ে নিয়ে থামবে করোনা?