নিজস্ব সংবাদদাতা: দেওয়া আর নেওয়ার নিরীখে ২০২০ শুধু নিয়েই গেল! হয়ত শুধু এখানকারই নয়, রাজ্য, দেশ ও বিশ্ব জুড়ে শুধুই কৃতি সন্তানদের হারিয়েছি আমরা। যাঁরা গেলেন তাঁদের অনেকেই এত কমবয়সে গেলেন কিংবা এত কর্মতৎপর অবস্থায় গেলেন যে তাঁদের যাওয়া শুধুই তাঁদের পরিবার নয়, পড়শি নয় আশেপাশের আরও বিস্তৃত এলাকার অসম্ভব ক্ষতি হয়ে গেল। হ্যাঁ, অনেকেই হয়ত পরিণত বয়সেই মারা গেছেন কিন্তু যখন গেছেন তখনও তাঁরা আমাদের কিছু না কিছু দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা থাকলে আরও অনেক পেতে পারতাম আমরা। সোজা কথায় তাঁদের যাওয়া এক এমন ক্ষতি যে ক্ষতিপূরণ হওয়ার নয়।
২০২০, ঘাতক কোভিড ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে আমাদের আবার তার বাইরেও মৃত্যু হয়েছে অনেকের। আমরা সেই সব মহাপ্রাণ যাঁরা আমাদের পাশ থেকে সরে গেলেন এই ২০২০ তে তাঁদেরই কয়েকজনের কথা স্মরণ করছি যদিও এর বাইরেও অসংখ্য মানুষ রয়ে গেছেন আম জনতার অংশ হিসাবে। যদি আমাদের এই আশে পাশে এরকমই কেউ থেকে থাকেন যিনি তাঁর নিজস্বতার বাইরে সমাজেও নিজেকে যুক্ত করেছিলেন অথচ এখানে উল্লেখিত হয়নি।আপনারা আমাদের জানালে তা সংযুক্ত করা হবে।
অভিশপ্ত দু’হাজার কুড়িতে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা হারিয়েছে বহু বিশিষ্টজনকে। এক্ষেত্রে মারণঘাতী কোভিড যেযন কেড়েছে অনেককে তেমনি অন্যভাবেও মারা গেছেন অনেকেই।
এই সময়কালে আমরা কালান্তক কোভিডে হায়িয়েছি প্রতিশ্রুতিমান তরুণ চিকিৎসক মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ বেরাকে। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার জলচকের বাসিন্দা ডাঃ বেরা দুই নাবালক সন্তান, স্ত্রী, বাবা, মা সবাইকে রেখে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে। পিংলার পাশের থানা সবং থানার মেজো বাবু অতনু প্রামানিককে হারিয়েছি আমরা। প্রামানিক জেলার প্রথম প্রত্যক্ষ করোনা যোদ্ধা যিনি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে একমাত্র নাবালক সন্তান, স্ত্রীকে রেখে প্রয়াত হয়েছেন। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ময়নার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। সবংয়ের বলপাই গ্রামের সাহিত্যিক তপজ্যোতি বেরাকে হারিয়েছে সাহিত্যজগৎ।
পার্শ্ববর্তী থানা ডেবরা হারিয়েছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী ইন্দ্রনীল রায়কে। রাধামোহনপুর হাইস্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক ইন্দ্রনীল রায় মাত্র ৫২বছর বয়সে চলে যান একমাত্র কন্যা ও স্ত্রীকে রেখে। ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক রায় থাকতেন খড়্গপুর শহরের প্রেমবাজার এলাকায়। বাদ যায়নি বেলদা থানাও। বেলদা থানা এলাকার বাসিন্দা খোকন সিং যিনি বেলদা গ্রামীন হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ছিলেন কোভিড সংক্রমনে প্রাণ হারিয়েছেন। তিনিই জেলার প্রথম স্বাস্থ্যকর্মী যিনি করোনায় প্রান হারান।
মেদিনীপুর শহরে আমরা কোভিডে হারিয়েছি মেদিনীপুর কলেজিয়েট হাইস্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষক আশিস কর কে। হারিয়েছি বিশিষ্ট আইনজীবী সমরেন্দ্র নাথ রায় কে। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বিশিষ্ট শর্টফিল্ম নির্মাতা পার্থ সারথি শ্যাম। হারিয়েছি মেদিনীপুর ক্ষুদিরাম নগরের বাসিন্দা বীরভূম জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক অমল রায় কে। হারিয়েছি সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী সুবীর সামন্তকে।এই সময় কালে প্রয়াত হয়েছেন মেদিনীপুরের বিধায়ক তথা মেদিনীপুর-খড়্গপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান মৃগেন্দ্রনাথ মাইতি। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী হায়দার আলি। প্রয়াত হয়েছেন মেদিনীপুরের প্রতিশ্রুতিমান শিক্ষক সঞ্জয় পাহাড়ী। এছাড়াও প্রয়াত হয়েছেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী উজ্জ্বল নাগ। শহরের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংস্কৃতি সংগঠক রঘুনাথ ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয়েছে এই সময়ে। কর্মচারী আন্দোলনের প্রবীণ নেতা কানাই দাসও প্রয়াত হয়েছেন ২০২০র শেষ লগ্নে।
এছাড়াও প্রয়াত হয়েছেন মেদিনীপুর রাঙামাটি পূজা কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক ও ক্রীড়াব্যক্তিত্ব গোপাল কর্মকার। বিদ্যাসাগর সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের প্রাক্তন চেয়ারম্যান যুগল কিশোর তুং। বিদ্যাসাগর সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের অন্যতম রানিং ডিরেক্টর অঞ্জন বেরা। মেদিনীপুর কলেজের প্রাক্তনী সিধু-কানু-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক বরুণ দাস, বামপন্থী নেতা শিবু চৌধুরী।পূর্ব মেদিনীপুর জেলার জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক নির্মল চন্দ্র মাইতি যিনি খালিপদ মাইতি নামে পরিচিত ছিলেন তাঁর প্রয়ান হয়েছে এই সময়কালে।
খড়গপুর শহরও মর্মান্তিক মূল্য দিয়েছে ২০২০ সালে। শহরের তিন প্রখ্যাত চিকিৎসক প্রয়াত হয়েছেন কোভিড সংক্রমন অথবা সংক্রমনোত্তর ধকলে। প্রবীণ চিকিৎসক ও ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এ্যসোশিয়েশনের খড়গপুর শাখার সভাপতি ডাঃ দিগীন্দ্রনাথ পাল, শহরের বিশিষ্ট চিকিৎসক, সঙ্গীত শিল্পী ডাঃ গৌরাঙ্গ বিশ্বাস, প্রবীণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ এ.কে. মাইতি বা অশোক কুমার মাইতিকে হারিয়েছে শহর। হারিয়েছে তরুণ তুর্কি, পরোপকারী স্বাস্থ্যকর্মী ৩৭বছর বয়সী সুমন দে কে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে এই শহর। প্রয়াত হয়েছেন বিশিষ্ট বামপন্থী নেতৃত্ব শোভানাথ বসু। এছাড়াও প্রয়াত হয়েছেন শিক্ষক আন্দোলনের প্রাক্তন সর্বভারতীয় নেতৃত্ব তুষার পঞ্চানন। শহরের বিশিষ্ট সমাজসেবী, রেলকর্মী চঞ্চল কর-এর মত মানুষকেও হারিয়েছে এই শহর।
ঘাটালে প্রয়াত হয়েছেন কৃষক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা শেখ ইসরাইল। মাত্র ২৪ঘন্টার ব্যবধানে প্রয়াত হয়েছেন তাঁর স্ত্রীও। পাশের জেলা ঝাড়গ্রাম হারিয়েছে সেখানকার প্রবীণ বিধায়ক, প্রাক্তন মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার ডাঃ সুকুমার হাঁসদাকে। জেলার করোনা যোদ্ধা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক-২ ডাঃ সুবোধ মন্ডলও প্রয়াত হয়েছেন ২০২০ সালে। সব মিলিয়ে শুধুই একটা হারানোর বছর পেরিয়ে এলাম আমরা। এরপর ২০২১! খবর পাওয়া গেছে ঘাতক করোনার দ্বিতীয় সংস্করন ইতিমধ্যেই প্রবেশ করেছে দেশে, কলকাতাতেও। এখন দেখার এই বছর আমাদের কী কী দেয় নাকি শুধুই নিয়ে যাবে এই নতুন বছরটাও?