বীর শহিদ
তিলকা মাঝি
বিনোদ মন্ডল জিওয়ী চালা: মায়াম লিঙ্গি:…..
বাবন পিছো: ভাই রে….
শহিদ -ভূমি ভারতবর্ষের মাটি বীরপ্রসূ। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনপণ লড়াইয়ের দিনলিপি লেখা তার পরতে পরতে । বহমান সেই স্রোতধারায় সাঁওতাল গণসংগ্রামের জীবন্ত ইতিহাস- -বীর শহিদ তিলকা মাঝি । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণ আন্দোলনের প্রথম অমর শহিদ তিনি। তিনি,জাবরা পাহাড়িয়া,বাবা তিলকা মাঝি (১১-০২- ১৭৫০ — ১৩-০১- ১৭৮৫)।
তাঁর নেতৃত্বে আদিবাসী জনজাতির ব্রাত্য জন যে মহত্তর সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন তা ইতিহাসে “খেরওয়াড় বিদ্রোহ “নামে খ্যাত । তার চেয়ে বড় সত্য হল এই বিদ্রোহবন্হি থেকে যে সংগঠিত সংগ্রামমালা রচিত হয়েছে – তা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে শহরে। ডহর থেকে রাজপথে । তামাড় বিদ্রোহ (১৭৮৯), চূয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৯),ভিল বিদ্রোহ (১৮০০),খাসী বিদ্রোহ (১৮২৯), কোল বিদ্রোহ (১৮৩১), ভূমিজ বিদ্রোহ (১৮৩৩),নাগা বিদ্রোহ(১৮৩৮) এবং সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫) । সুকান্তের বয়ানে “এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ / দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ ।”
তা এই বিদ্রোহমালার প্রথম মালাকর অবশ্যই অকুতোভয় বাবা তিলক মুরমু। তাঁর বাবা চুনু মুরমু ছিলেন গ্রামপ্রধান। স্বভাবতই বনবাসী মানুষের সুখদুঃখের ভাগিদার তিনি জন্মসূত্রে। বিহারের ভাগলপুর জেলা , থানা – সুলতানগঞ্জে তাঁর জন্ম । যে গ্রামে তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছেন সেই গ্রাম তাঁকে নয়নের মনি হিসেবে বেছে নিয়েছে । তাই গ্রাম নাম আজ তিলকপুর । কৈশোর থেকে দুরন্ত দামাল এই মানুষটি ছিলেন জেদী,একরোখা ,প্রখর মেধাবী ও দূরদর্শী । তাই ভাগলপুরের ‘ জনদরদী’ কালেক্টর ক্লিভল্যান্ডের পাতা ফাঁদে অন্যান্যরা পা দিলেও তিনি ছিলেন সদা সতর্ক। রাজমহল পাহাড়ে তাদের জঙ্গল কেটে বসতি গড়তে সাদর আহ্বান জানানো হল। এলাকাটার গাল ভরা নাম হল—‘দামিন-ই-কোহ।’ পাহাড়িয়াগণ ঘৃণা ভরে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। তবে সহজ সরল অকপট সাঁওতাল মানুষজন জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপনে এগিয়ে আসেন ।
ব্রিটিশরা দামিন-ই-কোহ প্রতিষ্ঠার সময় বন্ধু সেজে নানা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ঝরিয়ে দেন । তোমরা যত খুশি জায়গায় জঙ্গল সাফ করে চাষবাস করো না কেন প্রথম তিন বছর কোনো খাজনা নেব না । তিন বছরের পর নামমাত্র নেব ,পরে জমি উর্বর ও ফলবতী হলে সাধারণ হারে খাজনা নেওয়া যাবে । কিন্তু কোথায় কী ? বসতি স্থাপনের পর থেকেই উচ্চ হারে খাজনা ধার্য হয়ে গেল । শুধু খাজনা ধার্য করেই ক্ষান্ত হলো না ধান্দাবাজ কোম্পানী-সাহেবরা নিত্য নতুন শর্ত আরোপ করে লঙ্ঘন করা শুরু হলো মানবাধিকার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ।
হাল আমলের সফল যাত্রা পালা হলো মা মাটি মানুষ । কিন্তু সাঁওতাল আদিবাসীরা তো হাজার হাজার বছর ধরে মাটিকে মাতৃজ্ঞানে পুজো করে আসছে । জন্মসূত্রে তারা জেনে এসেছে মাটি বা জমির উপর তাদের অধিকার সহজাত । যেমন সহজাত তাদের অরণ্যের অধিকার । চতুর গোরা সাহেবরা প্রথমে ভুলিয়ে তাদের অরণ্যের জীবন, অরণ্য-সংস্কৃতি ধ্বংস করল, তার পর কোপ বসাল জমির উপর । স্বভাবতই ক্ষোভ বিক্ষোভ ক্রমাগত বাড়তে লাগল। খাজনা দিতে অস্বীকার করল তারা । কোম্পানী ও নাছোড় ।শুরু হলো দমন পীড়নের দাওয়াই। প্রথমে মারধর ,তারপর কুঠিতে এনে কয়েদ করা,তারপর ঘর জ্বালানো ,মা বোনেদের সম্ভ্রম লুঠ ,যূথবদ্ধ অত্যাচারের নৃশংস অধ্যায় ।বাবা তিলকা এই দুঃসময়ের ফসল।
স্বপ্নসন্ধানী এই দামাল গোপনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন মনে মনে । এবার পথে নামার পালা। গড়ে তুললেন মুক্তিবাহিনী । সাহসী সংগঠক তিলকা তরুণ যুবকদের নিয়ে এলাকায় এলাকায় রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে দুর্নিবার যুবশক্তি প্রচলিত কৌশলে প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন । নিজে তুখোড় বাঁটুলবাজ। সংগে অগ্রাধিকার পেল তীরন্দাজি । এর সাথে যুক্ত হল পরিস্থিতি অনুযায়ী রণকৌশল । গেরিলা কায়দায় ইংরেজদের উপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলতে লাগল লাগাতার । আদিবাসী, ভীল, মুন্ডা ,গারো সব উপজাতি তখন তিলকার নেতৃত্বে এককাট্টা । স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হল জঙ্গলমহল । হুপুচ হুপুচ ফেলায়া……..।
মরিয়া তরুণের দল যারা প্রথম ধাপে সরাসরি তিলকার দ্বারা প্রশিক্ষিত হলেন,তারা ছোট ছোট শাখায় ভাগ হয়ে ছড়িয়ে গেলেন গ্রাম থেকে গ্রামে। প্রতিটি এলাকায়,প্রত্যন্ত অঞ্চলে।স্থানীয় ভাবে সর্বত্র গড়ে উঠল সাঁওতাল মুক্তি বাহিনী।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন বাবা তিলকা মাঝি । সন্ত্রস্ত সাহেবরা ত্রাহি ত্রাহি রব তুলল। আতঙ্কে ঘুম উড়ে গেল তাদের । মাঝে মাঝেই কোম্পানীর বাহিনীর সাথে মুক্তি বাহিনীর টক্কর শুরু হল। দুপক্ষের প্রাণহানি তখন নিত্যদিনের ঘটনা । এমনই এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন হল — ১৩ জানুয়ারি ১৭৮৪ । তিলকার বাঁটুলের গুলিতে মারাত্মক জখম হলেন অগস্টাস ক্লিভল্যান্ড। প্রায় সাড়ে তিন বছর তিনি ভাগলপুরের কালেক্টর পদে কাজ করেন । পাহাড়িয়াদের সংগে সম্পর্কও ছিল আপাত মধুর । ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন একদিন । এই ঘটনায় সাহেবদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হল । প্রতিশোধ স্পৃহায় হাজার হাজার সৈন্য এনে গ্রামের পর গ্রামে গিয়ে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল কোম্পানীর সেপাইরা ।
১৭৭৮ সালে মাত্র ১১০০ থেকে ১৩০০ তরুণ ছিল এই বাহিনীতে । তাতেই তারা রামগড় ব্যাটেলিয়ন দখল দিয়েছিল । ট্রেজারী কুঠির সব অর্থ লুঠ করে বিলিয়ে দিয়েছিলেন সব হারানো গ্রামবাসীদের মধ্যে । জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন তিলকা । প্রতিটি এলাকায় ঘুরে ঘুরে বাহিনীর সাথীদের মধ্যে সংগ্রামী মনোবল বৃদ্ধি করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার । প্রয়োজনে জঙ্গলেই রাত্রিবাস।ক্ষুত্পিপাসা মেটাতে সামান্য রসদ সংগ্রহ । মন্ত্র একটাই বেনিয়া কোম্পানীকে ঠেকাতে হলে আমাদের একজোট হতে হবে । বিহারের সুদীর্ঘ বনভূমিকে এককাট্টা করতে তিনিই প্রথম ডাক দিলেন -আদিম উপজাতি একজোট হও। ‘জীবন যাক চলে, ঝরুক রক্ত। আমরা কিছুতেই পিছু হটবোনা ।’ শুরুতে ব্যবহৃত স্লোগানের মর্মার্থ এটাই । তার দেড়শ বছর পরে আজাদ হিন্দ বাহিনীকে সংগঠিত করে নেতাজী বজ্র নির্ঘোষে আবেদন করেন – “Give me blood. I shall give you freedom” .
বহুবার চর মারফত খবর পেয়ে ইংরেজরা নির্দিষ্ট গ্রামে গভীর রাতে হানা দিয়েও তাঁকে ধরতে পারেনি । আদিবাসী মানুষই তাঁকে আড়াল করেছে ,রক্ষা করেছে, গোপনে অকুস্থল ত্যাগে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে তীব্র সন্দেহে আক্রোশে, পরাজয়ের গ্লানিতে গোরা পল্টন ধ্বংস করেছে গ্রামের পর গ্রাম । ফসলের মরাই, তন্বী তরুণী, কুঁয়োর জল, বসত বাড়ি শেষ করে দিয়েছে । লুঠ করে নিয়েছে ।প্রত্যুত্তর দিয়েছে গেরিলা বাহিনী ।
সাহসী জবাব- কুঠি বাড়ি, সেনা ছাউনি, তোষা খানা, বারুদ ঘর, এমন কি প্রয়োজনে সমুখ সমরে চোখে চোখ রেখে বাঁটুল আর তীরের আঘাতে কেড়ে নিয়েছে বহু গোরা সৈন্যের প্রাণ ।
এমনই এক বীর বিক্রম লড়াই এর সাক্ষ্য দেয় ভাগলপুরের কাছে সুলতানগঞ্জ প্রান্তর । তিলকা মাঝির মুক্তিবাহিনী বনাম ইংরেজ সেনাবাহিনীর মুখোমুখি লড়াই । বিপক্ষের নেতৃত্বে তখন অত্যাচারী লর্ড আয়ার ক্রুট। জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া বাবা তিলকা ও তার বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কোম্পানী-সেনা। জঙ্গলে এগোতে গেলে প্রাণহানি অবশ্যম্ভাবী। তাই তা না করে অপেক্ষা করা, অধীর আগ্রহে । কিন্তু কতদিন আর জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা যায় ,বিনা রসদে ! কিছুদিনের মধ্যেই তীব্র খাদ্য সংকটে জেরবার হয়ে মরণপণ লড়াই এর জন্য বেরিয়ে আসে তিলকা মাঝির নেতৃত্বে আদিবাসী তরুণের দল । ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত বাহিনীর তির-বাঁটুল গেল ফুরিয়ে । শুরু হল বর্শা,বল্লম, লাঠি, গাছের ডাল এর ব্যবহার। প্রশিক্ষিত ইংরেজ সেনার সাথে অসম লড়াইয়ে পরাস্ত হলেন জাবরা পাহাড়িয়া। বহু বিদ্রোহী তরুণ প্রাণ দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। ধরা পড়লেন তিনি ।
প্রতিশোধে, জিঘাংসায় উন্মাদ ব্রিটিশরা আদিবাসীদের চূড়ান্ত শিক্ষা দিতে নতুন কৌশল ব্যবহার করল । প্রকাশ্য প্রান্তরে চাবুকে জর্জরিত ও ক্ষত বিক্ষত করা হল। ছিঁড়ে গেল পোষাক । সারা গায়ে জখম। তবু চাবকে যখন শেষ করা গেলনা, দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে ঘোড়ার সংগে বেঁধে ছোটানো হল সারা শহরে । মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করার জন্য । বোঝানো হল -সাবধান !
এই পরিণতি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে । আত্মসমর্পণ করো। বাঁচো। খাজনা মেটাও। বশংবদ হও। বীরের মৃত্যু নিয়ে আদিবাসী সমাজে নানা কিংবদন্তি, নানা অতিকথন চালু আছে। সেটাই স্বাভাবিক। শোনা যায়, পাঁচটি ঘোড়ায় বেঁধে তাঁকে দীর্ঘ পথ মাটিতে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। সারা শরীর ঘুরে ফিরে আছাড়ি পিছাড়ি খায়, ক্ষত বিক্ষত হয়। ঠিকরে বেরিয়ে আসে দুটো চোখ -আগুনের গোলার মতো। তাতেও তিলকার প্রাণ শেষ হয়না । তখন প্রান্তরের এক বট গাছের ডালে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া তাঁর । প্রাচ্যের বীর স্পার্টাকাস সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণসংগ্রামে প্রথম শহিদের মৃত্যু বরণ করেন ।
ভাবতে ভালো লাগে, ভাগলপুরের মানুষ বাবা তিলকার স্মৃতিকে অমলিন রাখতে নানা কর্মসূচি রূপায়ণ করেছেন । যার সব চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত – ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয় এর নাম পরিবর্তন করে আজ তিলকা মাঝি ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামাঙ্কিত হয়েছে । ভাগলপুরের অকুস্থলে শহিদ -স্মরণে স্থাপিত হয়েছে তিলকা মাঝির পূর্ণাবয়ব মূর্তি ! আজকের দিনে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর নামে শিক্ষাঙ্গন, লাইব্রেরি, ময়দান, ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । যার মাধ্যমে চলমান প্রতিষ্ঠান তিলকা মুরমু রক্তপ্রবাহে মিশে গেছেন ভারতভূমির !