মাতৃভাষায় জ্ঞান-সাহিত্য চর্চায় পথিকৃৎ: অক্ষয় কুমার দত্ত বিনোদ মন্ডল বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগর এর সমতুল ভূমিকা পালন করেছেন অক্ষয় কুমার দত্ত(১৫.৭.১৮২০–১৮.৫.৮৬)। শুধু গদ্য সাহিত্য বলি কেন, বাংলা জ্ঞান-সাহিত্য চর্চায় তাঁর ভূমিকা পথিকৃতের। বাংলা গদ্য রচনায় প্রথম যতি চিহ্নের প্রবর্তক তিনি।
বহুমুখী প্রতিভাধর এই মানুষটির আবির্ভাবের ২০০ বছর পরেও সার্বিক মূল্যায়ণ হল না। এটাই আক্ষেপের। সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গবেষক, পত্রিকা সম্পাদক, সমাজসংস্কারক, বিজ্ঞান আন্দোলনের নিষ্ঠ সেনানী ছিলেন তিনি। গণিত, নৃতত্ত্ব, ভূগোল, পরিভাষা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, বিবর্তন তত্ত্ব, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব,পুরাতত্ত্ব এমনকি বিজ্ঞানের ইতিহাস ছিল তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র। বহুভাষাবিদ এই পণ্ডিতের ৬৬ বছরের জীবন। কিন্তু শেষ ৩০ বছর শারীরিক অসুস্থতায় স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব হয়নি।এতদ্সত্ত্বেও নানা সৃজনশীল কাজে ব্যাপৃত থেকেছেন আজীবন।
বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম বিজ্ঞান পুস্তক ‘ভূগোল’ তাঁর সৃষ্টি (১৮৪১)। এখানেই যতি চিহ্নের প্রথম প্রয়োগ শুরু হয়। এছাড়া বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক মৌলিক গ্রন্থ পদার্থবিদ্যা (১৮৫৭) রচনারও কৃতিত্ব তাঁরই। বহু পরিভাষা আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি, যা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। যেমন মানমন্দির, জোয়ার, রামধনু, তড়িৎ, জড়, বাষ্প, বজ্র, পরিমিতি, চুম্বক, অঙ্গার, গ্রহণ, অণুবীক্ষণ, ধ্রুবতারা, দাহ্য, আগ্নেয়গিরি, দূরবীন ইত্যাদি।
ভাববাদের বিরুদ্ধে ঘোষিত বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। ইচ্ছে করে বারবেলা, কালবেলা, কালরাত্রি, অশ্লেষা, মঘা, ত্র্যহস্পর্শ, ‘অশুভ’ দিনক্ষণ দেখে ‘শুভকাজ’ আরম্ভ করতেন বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাত্রা করতেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ এর জন্য তাঁর বীজগণিতের সমীকরণ ব্যবহার তখনকার কলকাতায় উপাদেয় আলোচ্য হয়ে ওঠে। হিন্দু হস্টেলের জনৈক ছাত্রের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন — পরিশ্রম= শস্য। / পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য। অতএব, প্রার্থনা =শুন্য। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স’ তাঁর প্রদান করা তহবিলে গড়ে ওঠে।
সঞ্জীবনী পত্রিকার সম্পাদক বাবু দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী তাঁর পত্রিকায় অক্ষয় কুমার সম্পর্কে একটি মজার তথ্য ছেপেছিলেন। ১৮৫১ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিক্রমপুরে গোঁড়া প্রাচীনপন্থীরা কালীপাড়া স্কুল জ্বালিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল।গ্রন্থটির নাম “বাহ্য বস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার”। পাশ্চাত্য প্রভাব সত্ত্বেও এ গ্রন্থে অক্ষয় কুমারের মৌলিকত্ব ঈর্ষণীয়। এখানে তিনি হবু দম্পতিদের জন্য কয়েকটি বিজ্ঞানসম্মত পরামর্শ ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন, বিয়ের আগে দুজনের আলাপ পরিচয়, ভাবের আদান-প্রদান, রুচি সংস্কৃতির চর্চা হওয়া জরুরি। উভয়ের মধ্যে বয়সের ব্যবধান বেশি না থাকা বাঞ্ছনীয়। দাম্পত্য জীবন নির্বাহে দুজনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সমান সমান হওয়া দরকার। যা পূর্ব বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সম্পাদিত হওয়া উচিত।সর্বোপরি কোনও কারণে দাম্পত্য জীবনে চিড় ধরলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান যদি সম্ভব না হয়, তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদই হলো সন্তোষজনক পথ, যা বাস্তব সম্মত। সেকালে এসব ভাবনা সমাজে আলোড়ন তোলে।দলে দলে স্কুলের ছেলেরা ঘোষণাপত্রে সই করে জানায়, তারা শপথ নিচ্ছে এই পথেই বিবাহ অভিযান সম্পন্ন করবে। যার পরিণতিতে কালীবাড়ি স্কুলের অভিভাবকরা স্কুলে আগুন দিতে এসেছিল।
পত্রিকার খিদে মেটাতে তাঁকে অনবরত নানা লেখা লিখতে হয়েছে। ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার অগ্রগণ্য কলমচি ছিলেন তিনি।এছাড়া দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রথমে সহসম্পাদক এবং পরে সম্পাদক পদে নিয়োগ করেন (১৮৪৩)। তাঁর সুদক্ষ সম্পাদনায় এই পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা ৭০০ পেরিয়ে যায়।এই পত্রিকার সুবাদে শোভাবাজার রাজবাড়িতে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। এখানে দুজনে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ইংরেজি অংক করতে যেতেন। ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম কৃতবিদ্য ব্যক্তিত্ব আনন্দমোহন মিত্র, অক্ষয় কুমারের একটি লেখা প্রয়োজনমতো সংশোধন করে দিতে বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করেন। বিদ্যাসাগরের সংশোধনী দেখে অক্ষয় পরম প্রীত হন এবং উভয়ের সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে।
অক্ষয় কুমারের পরামর্শে ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনীর পেপার কমিটিতে বিদ্যাসাগরকে যুক্ত করা হয়। যার ফলে নিছক ধর্মপ্রচারের জন্য অধ্যাত্ম তত্ত্বের খোলস ছেড়ে সমাজ, নৃতত্ত্ব, বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ ও সংস্কারের পথে পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উভয়ের কাজকর্মে বিরক্ত হয়ে এই দুই নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষকে পত্রিকার দায়িত্ব থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও কোনো কোনো গবেষকের মতে পত্রিকা দপ্তরে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাধ্য হয়ে কাজ ছেড়ে দেন অক্ষয় কুমার। তখন কোন আওয়াজ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। এরপর জীবিকার প্রয়োজনে বিদ্যাসাগরের ব্যবস্থাপনায় বছরখানেক নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ পদে কাজ করেন তিনি।
দুজনে মিলে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাকে নানা সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ারে রূপান্তরিত করেন। এখানেই বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তা প্রথম প্রকাশ করেন। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে সরকার আইন প্রণয়ন করলেও তাঁদের বহুবিবাহ রদ আইনের উদ্যোগ সফল হয়নি। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর কিশোরী চাঁদ মিত্রের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিশোরী চাঁদ মিত্র ও অক্ষয় কুমার দত্ত। অক্ষয় কুমার যখন খুবই অসুস্থ, শয্যাশায়ী, তত্ত্ববোধিনীর সঙ্গে সম্পর্কহীন, তখন তাঁর সহায়তার জন্য দেবেন্দ্রনাথের আপত্তি সত্ত্বেও পত্রিকার তহবিল থেকে আমৃত্যু মাসিক ২৫ টাকা বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা সম্পাদিত হয়। প্রস্তাব পেশ করেন কানাইলাল পাইন।সভায় উপস্থিত না থেকেও আড়ালে থেকে জোরালো সমর্থন প্রদান করেন বিদ্যাসাগর।
অক্ষয় কুমারের চারুপাঠ (অখন্ড) সেকালে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। হাওড়ার বালিতে জায়গা কিনে বাড়ি ও সংলগ্ন শোভনোদ্যান গড়ে তোলেন তিনি। যা দেখে চমৎকৃত বিদ্যাসাগর নাম দেন চারুপাঠ চতুর্থ ভাগ। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) মাত্র চার বছর ঠাকুরদার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন।মানুষটি বাংলার বুকে ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়কে নিয়ে দুই খণ্ডে সমীক্ষা পত্র প্রকাশ করে গেছেন। এখানে ১৮২ টি সম্প্রদায়ের কথা আলোচিত হয়েছে। শুধু আলোচনা নয়, এই গ্রন্থের মাধ্যমে ভাববাদ, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ করেছেন তিনি। ভাবতে অবাক লাগে, উনবিংশ শতকের বাংলায় একজন প্রাবন্ধিক ধর্মাচরণের প্রাবল্যকে মানসিক রোগ বলে চিহ্নিত করার সাহস দেখাচ্ছেন। যা বর্তমান ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে বলতে গেলে ভারভারা রাওয়ের সাথে রাত কাটাতে হবে, অনিবার্য।
পাঠকের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল অপরিসীম। নানা তথ্য জানতে চেয়ে অনুরাগীরা প্রতিনিয়তঃ তাঁকে চিঠি লিখতেন। একসময় অসুস্থতার জন্য তিনি যখন সে সবের উত্তর দিতে পারছেন না, তখন কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে অপারগতার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এমনই কয়েকটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে–সোমপ্রকাশ (১১ বৈশাখ, ১২৯০), সঞ্জীবনী (৮ বৈশাখ ১২৯১) এবং নিউজ অফ দ্য ডে (১০ জুন ১৮৮৫) সংবাদপত্রে।
১৮৪৩- এ দেবেন্দ্রনাথ প্রথম যে ১৯ জন সহযাত্রীকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করেন তাদের একজন ছিলেন তিনি। কিন্তু অক্ষয়ের পথ ক্রমাগত সরে সরে গেছে। ব্রাহ্ম থাকাকালীন ফরাসি একাত্মবাদ পরে অজ্ঞেয়বাদ তারও পরে নাস্তিক্যবাদ এবং সবশেষে যুক্তিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন অক্ষয় কুমার। জনারণ্যে মিশে যেতেন অনায়াসে। ‘পল্লী গ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন’ সেই মিতালির স্বাক্ষর।
বাংলা নবজাগরণের ইতিহাসে তাঁর নাম যথাযথ মর্যাদায় ধ্বনিত হোক এই আবেদন স্বহৃদয় ইতিহাসকারদের কাছে রাখা হলো। বুকে বল পাই যখন দেখি, ১৮৮৩ সালের ৩১ আগস্ট তাঁকে পাঠানো চিঠিতে জার্মানি থেকে ভারত বন্ধু ম্যাক্সমুলার লেখেন ‘আপনার অসুস্থতার খবর শুনে খুব দুঃখিত। আশা করি আপনি অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারবেন।’জ্ঞানসাহিত্য চর্চার হাত ধরেই তিনি বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠেছিলেন।