Homeএখন খবরক্রান্তিকালের মনীষা-৪১।। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।। বিনোদ মন্ডল

ক্রান্তিকালের মনীষা-৪১।। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।। বিনোদ মন্ডল

কৃষ্ণনাগরিক
            দ্বিজেন্দ্রলাল                     বিনোদ মন্ডল                      কৃষ্ণনগরের ভূমিপুত্র দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৯.০৭. ১৮৬৩ — ১৭.০৫.১৯১৩) উনিশ শতকের নবজাগরণে স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন কবি নাট্যকার গীতিকার সুরকার এবং সুরসিক গায়ক। আক্ষেপের বিষয় বর্তমান প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে উদাসীন; তিনি তাঁর যোগ্য মর্যাদা পাননি।

তাঁর বাবা কার্তিকেয় চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান। প্রখ্যাত খেয়াল শিল্পী এবং সাহিত্যিক। তাঁর ঠাকুরদা মদনগোপাল রায়ের নাম অন্নদামঙ্গলে অন্বিত করেছেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। তাঁর দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনী দেবী নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করতেন। অর্থাৎ বংশ সূত্রে এবং রক্ত সূত্রে তিনি ছিলেন সারস্বত সমাজের সামাজিক। কিন্তু ‘সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ।’ অথবা ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’র বাইরে আজকের বাঙালি তাঁকে মনে রাখতে পারেনি। তাও অনেক বিখ্যাত বাঙালি আবার ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা উচ্চারণে কাজ চালিয়ে নেন। তবে “ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে” জাতীয় কালজয়ী সৃষ্টিগুলির জনপ্রিয়তা আজও যথেষ্ট।

প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাস করে স্কলারশিপের টাকায় ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন তিনি। কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। দেশে ফিরে ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি জীবন শুরু করেন। তবে তাঁর চরিত্রের মধ্যে এমন কিছু উপাদান ছিল যা তাঁকে প্রতিনিয়ত বিতর্কে জড়িয়ে ফেলতে উৎসেচিত করত। সৎ, উদার, বন্ধুবৎসল এই কৃতী অকারণে ক্ষণিক উন্মাদনায় মেতে উঠতেন। ফলে যা-কিছু আকস্মিকতায় বিভ্রান্তি ঘটিয়ে ফেলতেন, তার মাশুল আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। কখনো বঙ্গভঙ্গের উত্তেজনায় মেতে উঠেছেন, কখনো রঙ্গমঞ্চের আকর্ষণে আলোড়িত হয়েছেন, কখনো তীব্র মাদকাসক্তিতে আত্ম সংবরণ হারিয়েছেন, কখনো সাহিত্যে নীতিবাদ নিয়ে রবীন্দ্রবিরোধী হয়ে বিতর্ক ছড়িয়েছেন। তাঁর বন্ধু লোকেন পালিত তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন করে বলেছেন ‘দ্বিজু যখন যাই ধরতেন, half heartedly, করতে পারতেন না।’

বিলেত থেকে ফিরে ১৮৮৬ সালে কাজে যোগ দেন। ১৮৮৭ তে স্বনির্বাচিত সুরবালা দেবীকে বিয়ে করেন। ১৮৯৭ সালে সুযোগ্য পুত্র দিলীপ কুমার এবং ১৮৯৮ সালে একমাত্র কন্যা মায়া জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৩ সালে তাঁর বয়স যখন ৪০, স্ত্রী বিয়োগ ঘটে । প্রেমে ভরপুর এক আদ্যন্ত রোমান্টিক মন ভরে ওঠে নিরাশায়। উচ্ছ্বাস প্রিয় মানুষটির মাদক সেবন বেড়ে যায়। ক্লান্তিতে ভরে যায় জীবন। অর্ধ শতবর্ষের আগে নিবে যায় জীবন দীপ। পাশ্চাত্য প্রকরণে মুগ্ধ মানুষটি একদিকে ছিলেন দেশপ্রেমিক, অন্যদিকে ছিলেন ব্রিটিশের কল্যাণকামী উপনিবেশিকতায় মুগ্ধ ও আস্থাশীল। ফলে কখন কী ভূমিকা পালন করবেন তা নিয়ে দ্বিধান্বিত থেকেছেন আজীবন। তাই মেদিনীপুরে চাকরি করতে গিয়ে সুজামুঠা পরগনার কৃষকদের দুর্দশা লাঘব করতে তিনি খাজনা কমিয়ে দিয়ে শাসকের কোপের শিকার হন। এদিকে তাঁকে চাষিরা অভিনন্দিত করতে করতে দয়াল রায় নামে বিখ্যাত করে দেন।

দেশপ্রেম ও পাশ্চাত্য বোধে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করতে একের পর এক মঞ্চ সফল পালা উপহার দেন তিনি। পুরাণ ও ইতিহাস মিশ্রিত নাটকের পাশাপাশি সামাজিক পালা এবং প্রহসন মিলিয়ে সংখ্যাটা কম নয় – একুশ। এরমধ্যে শাজাহান তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্য সৃজন। তেমনি জনপ্রিয় চন্দ্রগুপ্ত। তাঁর নাটকের সংলাপে সমাসবদ্ধ পদের ঘনপিনদ্ধ ব্যবহার, আবেগের থরথর আরোহন এবং ধ্বনিমাধুর্যের গাঢ়তা সেকালের রঙ্গ মঞ্চ আন্দোলনকে শুধু না, বিশ শতকেও বহু সৌখিন নাট্যদলকে অসংখ্য মঞ্চায়নের সুযোগ করে দিয়েছে। নাট্যীয় উৎকণ্ঠা, দ্বন্দ্ব এবং বিক্ষোভ সমাবেশে নাটকগুলি সেকালের দর্শককে রাতের পর রাত কোজাগর মুগ্ধতা দিয়েছে।

“ঔরঙ্গজেব।৷ মহম্মদ! উন্মাদিনী নারীকে এখান থেকে নিয়ে যাও! -এ- রাজ্যসভা উন্মাদাগার নয় মহম্মদ।
জাহানারা।। দেখি এই সভাস্থলে কার সাধ্য যে সম্রাট শাহজাহানের কন্যাকে স্পর্শ করে। সে ঔরঙ্গজেব এর পুত্র ই হোক আর স্বয়ং শয়তানই হোক।
ঔরঙ্গজেব।। মহম্মদ। নিয়ে যাও!
মহম্মদ।। মার্জনা করবেন পিতা! সে স্পর্ধা আমার নেই।
যশোবন্ত।। বাদশাহজাদির প্রতি রূঢ় আচরণ আমরা সহ্য করব না।
অন্য সকলে।। কখনোই না!
ঔরঙ্গজেব।। সত্য বটে! আমি ক্রোধে কি জ্ঞান হারিয়েছি। নিজের ভগ্নির – সম্রাট শাজাহানের কন্যার প্রতি দুর্ব্যবহার করবার আজ্ঞা দিচ্ছি! ভগ্নি অন্তঃপুরে যাও। এ প্রকাশ্য দরবারে শত কুৎসিত দৃষ্টির সম্মুখে, এসে দাঁড়ানো সম্রাট শাজাহানের কন্যার শোভা পায়না। তোমার স্থান অন্ত:পুর! (শাহজাহান/ ২য় অঙ্ক/ ৫ম দৃশ্য)

১৮৮৮ সালে মুঙ্গেরে বদলি হয়ে যান দ্বিজেন্দ্রলাল।সেখানে গিয়ে প্রসিদ্ধ খেয়ালিয়া সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের কাছে নাড়া বাঁধেন। বাল্যকাল থেকে গানে বিচরণ ছিলই। বিলেতে গিয়ে পাশ্চাত্য সংগীতেও তালিম নিয়েছিলেন। ফলে মুঙ্গেরে গিয়ে তাঁর গানের প্রতিভা স্বপ্ন উড়ান দেয়। সারা জীবনে পাঁচশো মতো গান লিখেছেন।স্বরলিপি সহ ধরা আছে ১৩২ টি। তাও ছেলে দিলীপকুমারের যোগ্য প্রয়াসে। বাকি অগোছালো মানুষটির আলগোছে সব এলোমেলো হয়ে আছে ইতি উতি। তাঁর গানের নানা পর্যায় । প্রেম। স্বদেশ । নাটকের গান । হাসির গান ।ভক্তিগীতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন হাস্যরসের গানে। সভা সমিতিতে তাঁকে দেখলেই শ্রোতারা দাবি করতেন — ‘হাসির গান – দ্বিজুবাবু একটা হাসির গান।’ আসলে সেকালের কলকাতায় হিন্দুস্তানি কালোয়াতি বা ব্রহ্মসংগীত একদিকে, অন্যদিকে টপ্পা কিংবা নাটকে ব্যবহৃত গান, বাঈজিদের গানের বাইরে তাঁর হাসির গানগুলো ভদ্র শ্রোতাদের কাছে টাটকা বাতাসের মতো তাজাতর ছিল।

নাটকে ব্যবহৃত গানগুলি অসাধারণ হলেও সাধারণ ও মধ্যমেধার অভিনেতা-গায়কের গলায় সুবিচার পায়নি। স্বরলিপি প্রস্তুতিতে তিনি অমনোযোগী ছিলেন। ফলে বহু গান যোগ্য বিচার পেলো না। মর্যাদা পেলো না। এ সমস্যা নিয়ে তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী(১৯১৫) সভায় আলোকপাত করেন ‘সবুজপত্র’ সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী, “দ্বিজেন্দ্রলালের গানগুলি যদি আমরা অতি সত্তর স্বরলিপিতে আবদ্ধ না করি তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সেসব সুর আমাদের চলতি সুরে পরিণত হবে। ” তাই ঘটেছে! অনেকে তাঁকে প্রেমের গানে সেরা বলে অভিহিত করেন। এর প্রধান কারণ তাঁর স্বপ্নময় দাম্পত্য- জীবন।এছাড়াও বিলাতপ্রবাসে এক বিদেশিনীর প্রণয়পাশে আবদ্ধ হয়েও তিনি বেশ কিছু সংরক্ত প্রেমের গান সৃষ্টি করেছেন। বিলিতি সুরে বাংলা গান রচনায়ও তিনি ছিলেন প্রথম রূপকার। তবে স্ত্রী-বিয়োগের পর হাসির গান একটিও লেখা হয়নি তাঁর। বরং শ্রান্ত, বিধ্বস্ত মানুষটি যখন চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, তখন ভক্তিগীতিতে শান্তির খোঁজে নিয়োজিত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একটি তথ্য অপ্রাসঙ্গিক হবে না, বন্ধুবৎসল দ্বিজেন্দ্রলাল জগদীশচন্দ্র বসুর অনুরোধে ‘বঙ্গ আমার, জননী আমার’ সংগীতটির নির্মাণ ও সুরারোপ করেছিলেন।

তাঁকে ঘিরে সমকালের উদাসীনতা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলে ভিলেনের মতো সামনে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ। বলা হয়, তাঁর অকারণ রবীন্দ্রবিরোধী মানসিকতার কারণেই বাংলা সাহিত্যের রাবীন্দ্রিক যুগ তাঁকে ইতিহাস থেকে ছেঁটে ফেলেছে! সর্বাংশে না হলেও অভিযোগ কিয়দংশে সত্য। তবে হুল্লোড়বাজ দ্বিজেন্দ্রলালকে অকারণেই রবীন্দ্রবিদ্বেষী করেছিল তাঁর স্বার্থান্বেষী বন্ধুবর্গ। এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়েছে। সারস্বত সমাজে অভিযুক্ত ডি.এল. তাই আংশিক নির্বাসনে সাজাপ্রাপ্ত। ক্রমাগত ব্যক্তি আক্রমণে ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ পাল্টা আক্রমণে যাননি; ক্ষমাসুন্দর থেকেছেন। অথচ এমনতো হওয়া উচিত ছিল না। ১৩০১ সালে সাধনা পত্রিকায় কবি রবীন্দ্রনাথ গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আর্যগাথা’ গীতি সংকলনের সপ্রশংস আলোচনা করেছেন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক সাধারণভাবে স্বাভাবিক ছিল। কুষ্টিয়ায় বসবাসকালে দ্বিজেন্দ্রলাল সস্ত্রীক রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। ১৩০৬ সালের ১২ আষাঢ়। নিজের লেখা ‘বিরহ’ নাটক রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছেন(১৩০৪)। তবু নানাভাবে লেখালেখি, সমালোচনা এবং পত্রাঘাতে রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল। এমনকি কবিগুরু যখন বিলেতে, তখন ‘আনন্দবিদায়’ নামে প্যারডি- নাটিকা লিখে সাপ্তাহিক বঙ্গবাসীতে প্রকাশ করেন দ্বিজেন্দ্রলাল। শুধু তাই নয় স্টার থিয়েটারে (১৬/১২/১৯১২) তা মঞ্চায়নও করা হয়।যদিও সে নাটক দেখে রবীন্দ্রানুরাগী বাঙালি দর্শক এমন বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন যে, প্রাণভয়ে মাঝপথে রঙ্গালয় ত্যাগ করেন দ্বিজেন্দ্রলাল।

কখনো প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি রবীন্দ্রনাথ। চারু বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে আত্মসমালোচনা করেছেন বরং – ‘আমার কবিতার মধ্যে অযোগ্য জিনিসও ঢের আছে – আমার বাঁশির সকল রন্ধ্রেই যে উঁচু সুর বেজেছে তা নয় – আমার প্রকাশের স্রোতের মধ্যে পাপের মূর্তিও যে প্রকাশ পায়নি এ কথা কখনোই সত্য নয়। কিন্তু নদীর জলে কাদা মিশানো থাকে বলে সেইটেই তো তার মুখ্য জিনিস নয় – সেটা সত্বেও যদি জল স্নানে পানে কাজে লাগে তবে পৃথিবীশুদ্ধ লোকও তাকে ক্ষমা করে – সেই ক্ষমা যদি দ্বিজেন্দ্রবাবুর কাছ থেকে একেবারে না পাই তবে আমার কবিত্বের গ্লানির চেয়ে তা চিত্তের গ্লানির জন্য আমি বেশি বেদনা পাব।’                      এই বেদনা থেকে মুক্ত হন রবীন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্র প্রয়ানের পর দেবকুমার রায়চৌধুরী রচিত দ্বিজেন্দ্র জীবন চরিতের ভূমিকা রচনার মাধ্যমে। ভাগ্যিস ‘কৃষ্ণনাগরিক’কে তা প্রত্যক্ষ করতে হয়নি!

RELATED ARTICLES

Most Popular