আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু: হৃদয়ে সাহিত্য চেতনায় বিজ্ঞান-২
অনিন্দিতা মাইতি নন্দী(গাছেরও মন-খারাপ হয়, দেখিয়ে দিলেন জগদীশ )
আচার্যের গবেষণার বিষয়বস্তু কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথম পর্যায় হল পদার্থবিদ্যা বিষয়ক গবেষণা। আর দ্বিতীয় পর্যায় হল- উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা। তিনি হয়ে উঠলেন জীব-পদার্থবিদ্যার পথিকৃৎ। তাঁর চর্চিত বিষয়টি ছিল পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্যে জৈবজগতের বিভিন্ন কার্যকারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা যা হল জৈবজগতে পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ। তিনি এই গবেষণার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রমান পান যে জীবের মতো তথাকথিত জড় বস্তুও সাড়া দেয় এবং এই ক্ষেত্রে উদ্ভিদ জগতের সাড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজের তৈরী যন্ত্রের সাহায্যে প্রমান করেন উত্তেজিত বা আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদজগতের স্পন্দনলিপি হুবহু একই রকম। এরফলে তিনি অনুভব করলেন যে জড়বস্তু, উদ্ভিদ আর প্রাণীর মধ্যে পরিষ্কার কোন বিভাজন রেখা নেই। তাঁর যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষালব্ধ প্রাপ্ত ফলগুলিও অনেক ইংল্যান্ডের উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এবং শারীরতত্ত্ববিদ (Physiologist) রা অস্বীকার করলেন।
তাঁরা আসলে একজন পদার্থবিদের উদ্ভিদ কিংবা জীববিজ্ঞানে প্রবেশটা ‘অনাধিকার চর্চা’ মনে করতেন। আচার্য যে যন্ত্রের সাহায্যে উদ্ভিদের চেতনাশক্তিকে ধরতে সমর্থ হন তা হলো তাঁর নিজস্ব আবিষ্কৃত যন্ত্র Resonant Recorder. এই যন্ত্রটির সাহায্যে বৃক্ষের বিভিন্ন স্পন্দন এবং উদ্ভিদের বৃদ্বির পরিমাণও নির্ণয় করা যায়। তাঁর নিজস্ব তৈরী ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’ (Crescograph) যন্ত্রের সাহায্যে তিনি দেখালেন টিনের একটি টুকরো, গাছের ডগা এবং ব্যাঙের একটি পেশী সবই বাইরের উত্তেজনায় হুবহু একই ভাবে স্পন্দিত হয়। তিনি অনুভব করলেন যে কীটপতঙ্গ প্রাণীজগৎ ও পশুজগৎ এমনকি ধূলিকণা সবই অণুজগতের ভিতর দিয়ে একই সূত্রে বাঁধা। ১৯১৮ খ্রী জগদীশচন্দ্র প্রমান করেন সাধারণ আলোর মধ্যে অতি বেগুনি রশ্মি ও নীল আলো উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে কমিয়ে দেয়। তিনি বলেন যে উদ্ভিদের প্রত্যেকটি কোষ একটি Photoelectric-controlled cell বা বিদ্যুৎ আলোক রশ্মি নিয়ন্ত্রণ কোষ। তিনি প্রমান করে দেখান যে ‘অজৈব বস্তু’ বা Inorganic Matter এর সাহায্যে গাছে সাড়া জাগানো যায়। তিনি লক্ষ করেন যে গাছেরও অবসাদ হয়, গাছও তীব্র আঘাতে ‘বেদনার সাড়া’ দেয়। আসলে তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল এই নির্বাক জীবন সম্পর্কে। তাই অক্লেশে তিনি বলতে পারেন:
”ঘর হইতে বাহির হইলেই চারিদিক ব্যাপিয়া জীবনের উল্লাস দেখিতে পাই। সেই জীবন একেবারে নিঃশব্দ। শীত ও গ্রীষ্ম, মলয়, সমীর ও ঝটিকা, বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি, আলো ও আঁধার এই নির্বাক জীবন লইয়া ক্রীড়া করিতেছে। কত বিচিত্র ঘটনার সমাবেশ, কত প্রকারের আঘাত ও কত প্রকারের আভ্যন্তরিক সাড়া। এই স্থির, এই নিশ্চলবৎ জীবন প্রতিমার ভিতরে কত অদৃশ্য ক্রিয়া চলিতেছে। কি প্রকারে এই অপ্রকাশকে সুপ্রকাশ করিব?” আচার্যের মনে সর্বদাই একটাই প্রশ্ন সারাক্ষন ঘোরে- ‘নির্জীব আর সজীবের মধ্যে পার্থক্য কোথায়’? নির্জীব আর সজীবের মাঝখানে আছে উদ্ভিদ তাই ধীরে ধীরে তিনি উদ্ভিদের উপর এক্সপেরিমেন্ট শুরু করলেন। ‘নির্জীব কখন সজীব হয়ে ওঠে’ এই সম্পর্কে প্রত্যক্ষ প্রমান সহ আচার্য জগদীশচন্দ্রের বক্তব্য যখন প্যারিসের কনফারেন্সে অদ্ভুত আলোড়ন তোলে তখন সেখানে স্বামী বিবেকানন্দ উপস্থিত ছিলেন।
স্বামীজী এই তরুণ বৈজ্ঞানিকের বাগ্মীতায় ও প্রত্যক্ষ প্রমানে যথেষ্ট মুগ্ধ হয়েছিলেন। আচার্যের বিদ্যুৎ তরঙ্গ এবং বেতার তরঙ্গ গবেষণা তখন ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়েছিল। এইসময় প্রেসিডেন্সিতে এই স্বনামধন্য তরুণ বৈজ্ঞানিকের সাথে আলাপ করতে ভগিনী নিবেদিতা আসেন আচার্যের গবেষণাগারে। নিবেদিতা এই ভেবে এসেছিলেন যে আচার্য যেভাবে বিনা তারে যান্ত্রিক কাজ করানোর যে সকল চমকপ্রদ পরীক্ষা পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানী মহলে দেখিয়ে এসেছিলেন, হয়ত তারই কিছু নিদর্শন তিনি ল্যাবরেটরিতে দেখতে পাবেন।
কিন্তু ল্যাবরেটরিতে এসে নিবেদিতা দেখলেন আত্মমগ্ন বিভোর এক আচার্যকে যিনি জড় ও জীবের মধ্যে ঐ ক্যসমন্বয়ের প্রচেষ্টায় আত্মনিবেদিত। নিবেদিতা দেখলেন জগদীশ্চন্দ্ৰ বলে যাচ্ছেন বৈদ্যুতিক উদ্দীপনায় জড়, উদ্ভিদতন্তু ও প্রাণীপেশী নাকি একইভাবে সাড়া দেয়। বারবার উদ্দীপনায় ক্লান্তি আসে তাদের। নিবেদিতা সবিস্ময়ে লক্ষ করেন জড় পদার্থের ক্ষেত্রেও উত্তেজনায় সারা দেওয়া, ক্লান্তিবোধ করা সবই ধরা পড়ছে আচার্যের যন্ত্রে, যা হল প্রাণের অনিবার্য লক্ষণ। নিবেদিতা বিস্মিত মুগ্ধ আবেগ বিহ্বল হয়ে আচার্য জগদীশ্চন্দ্রকে বলেন:
”আমায় যা বলেছ তা তোমার লিখে ফেলা উচিৎ। ” উত্তরে জগদীশচন্দ্র বসু বললেন অসহিষ্ণুভাবে, ”যা বিদ্যুৎচমকে আমার মনে খেলে যাচ্ছে, সে কল্পনাকে রূপ দেব কি করে? ওতো আমার কাছে মরীচিকা!”
নিবেদিতা উত্তরে বললেন:
”আমি তো আছি। আমার কলম অনুগত ভৃত্যের মতো তোমার কাজ করবে। মনে করো এ লেখা তোমারই।” এই ঐতিহাসিক কথোপকথনগুলি পাওয়া নিবেদিতার জীবনীকার লিজেল রেঁম -র রচনায়।
আচার্য বিশ্বাস করতেন যে, ”নতুন সত্য আবিষ্কার করিবার জন্য সমস্ত জীবনপণ ও সাধনার আবশ্যক।” তাই তিনি বিজ্ঞান সাধনা নিয়ে বলেন, “বৈজ্ঞানিককে যে পথ অনুসরণ করিতে হয় তাহা একান্ত বন্ধুর এবং পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের কঠোর পথে তাহাকে আত্মসম্বরন করিয়া চলিতে হয়”।জগদীশচন্দ্র পরীক্ষা করে দেখান যে নুন ও চিনির জলীয় দ্রবণ কিভাবে কিছু স্পন্দনশীল কোষের মাধ্যমে উদ্ভিদের উপরে উঠে সে। তিনি ‘নির্বাক জীবন’ –এর এক জায়গায় বনচাঁড়ালের স্পন্দনশীলতা নিয়ে কিন্তু অসাধারণ পর্যবেক্ষণ বর্ণনা দেন। ”বনচাঁড়াল গাছ দিয়া উদ্ভিদের স্পন্দনশীলতা অনায়াসে দেখানো যাইতে পারে। ইহার ক্ষুদ্র পাতাগুলি আপনা আপনি নৃত্য করে লোকের বিশ্বাস যে, হাতের তুড়ি দিলেই নৃত্য আরম্ভ হয়। গাছের সঙ্গীত বোধ আছে কিনা, বলিতে পারিনা, কিন্তু বনচাঁড়ালের নৃত্যের সহিত তুড়ির কোন সম্বন্ধ নাই।” আবার এই বনচাঁড়ালের নৃত্য নিয়ে সেই বিখ্যাত উক্তি ”তরুস্পন্দনের সাড়ালিপি পাঠ করিয়া, জন্তু ও উদ্ভিদের স্পন্দন যে একই নিয়মে নিয়মিত তাহা নিশ্চয় রূপে বলিতে পারিতেছি।”
জগদীশচন্দ্র মুগ্ধ হয়েছিলেন বনচাঁড়ালের উদ্ভিদের স্পন্দনশীলতা দেখে এই উদ্ভিদের পাতাগুলি নিজেরাই নৃত্যের ছন্দে আন্দোলিত হয়। তবে আচার্যকে সবচেয়ে বেশী মুগ্ধ মোহিত করেছিল লজ্জাবতী লতা। এই লজ্জাবতী লতার পাতা ও কান্ডের মধ্য দিয়েই উত্তেজনা বা স্পন্দনশীলতা বিভিন্ন ভাবে পরিবাহিত হয়। লজ্জাবতী পাতাকে electric shock বা দেশলাই কাঠির নিভন্ত আগুন ছোঁয়ালে এমনকি পাতাটির খুবই অল্প অংশ কাঁচি দিয়ে কাটলেও একটি অল্প বৈদ্যুতিক প্রবাহের উৎপত্তি হয়। আচার্য প্রমান করলেন যে এই বৈদ্যুতিক প্রবাহের গতির হার, উষ্ণতা ও বৈদ্যুতিক শকের (electric shock) তীব্রতাও পাতার পূর্ণতার উপর নির্ভরশীল। বিস্ময় জাগে, জগদীশচন্দ্র একজন পদার্থবিদ হয়েও যেভাবে সমস্ত প্রথা উল্টে নিজেকে একজন জীব বিজ্ঞানী হিসাবে সমগ্র বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ সফল ভাবে করেছেন জীববিজ্ঞানে।। তাই বিশ্বকবি নিজের ‘খেয়া’ বইটিতে তাঁকে উৎসর্গ করে লেখেন, ”পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে সে যে প্রাণের কথা।
যত্ন ভরে খুঁজে খুঁজে তোমায় নিতে হবে বুঝে
ভেঙে দিতে হবে যে তার নীরব ব্যাকুলতা।”
কেবলমাত্র বিজ্ঞানকে ভালোবেসে যে উদ্ভাবনী শক্তি, যে আনন্দবোধ যা কেবলমাত্র কাজ থেকেই পাওয়া যায় যা সফল হতে, এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দেয়। তাই আচার্য বলেন: ”আমি মূক উদ্ভিদের মুখে ভাষা জুগিয়ে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার ক্ষমতা প্রদান করেছি। উদ্ভিদের নিজেদের লেখা ওই বিবরণ প্রমান করে যে বিবর্তনের দিকে সবচেয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রাণীদের প্রাণ সংক্রান্ত এমন কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া নেই যার অভিঘাত উদ্ভিদে অনুপস্থিত।’
ভেবে বিস্ময় লাগে যে পরাধীন ভারতবর্ষে জন্মে তিনি সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় সবরকম প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেন আশ্চর্য মননশীলতায়, চারিত্রিক দৃঢ়তায়, প্রকৃত বিজ্ঞান চেতনায় ভারতবর্ষে আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম স্থাপতি তিনি। সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ১৯১৭ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। চলার পথে আচার্য তাঁর পাশে পেয়েছিলেন বন্ধু হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও ভগিনী নিবেদিতাকে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জগদীশচন্দ্রকে মনে করতেন এক বিজ্ঞান সাধক প্রতিভা দীপ্তি আর নিবেদিতা ছিলেন আচার্যের কন্টকাকীর্ণ পথের অতিক্রম করার প্রেরণা, যিনি তাঁর অকৃত্তিম সেবা, সাহচর্য ও সাহস দিয়ে আচার্যকে উদ্বুদ্ধ করতেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৭ সালে তাই উল্লেখ করেছিলেন, ”In the days of his struggles, Jagadish gained an invaluable energiser and helper in sister Nivedita and in any record of his life’s work, her name must be given a place of honor.”
জগদীশচন্দ্রের বারংবার সাফল্যে বিশ্বকবি জগদীশচন্দ্রের উদ্দেশ্যে লেখেন: ”তোমার খ্যাতির শঙ্খ আজি বাজে দিকে দিগন্তরে সমুদ্রের একূলে ওকূলে, আপন দীপ্তিতে আজি বন্ধু, তুমি দীপ্যমান।” জগদীশচন্দ্র শুধু একজন বিজ্ঞানী নন, আজ থেকে একশ বছরেরও আগে তিনি প্রথম পদার্থ ও জীববিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। জগদীশচন্দ্রের একটি অমর উক্তি ‘নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? – ‘মহাদেবের জটা হইতে।’ তেমনি আচার্যের কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, ‘আধুনিক বিজ্ঞান তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?”: ‘আচার্য জগদীশচন্দ্রের হাত ধরে।’
রচনা সূত্র (Reference): প্রকাশিত পর্ব-১ এ বিস্তারিত দেওয়া আছে।