চরণ ছুঁয়ে যাই -১ অনিন্দিতা মাইতি নন্দী মামাবাড়ির দেয়ালের একটি ছবি আমাকে খুব টানতো, বড়ো বড়ো দীঘল চোখ, একমাথা কোঁকড়ানো চুল, মাঝে চেরা লম্বা সিঁথির এক দীপ্ত পুরুষ। ছবির ওপরে লেখা থাকতো ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’। ছোটবেলা থেকেই এই ছবির প্রতি আমার অদ্ভুত একটা আকর্ষণ ছিল আমার। একদিন ছোটোমামাকে জিজ্ঞেস করি উনি কে? — উত্তর পেলাম কিন্তু এতো ছোট বয়সে অনুধাবন করার ক্ষমতা ছিল না এই বিরাট মাপের দীপ্ত পুরুষ কে।
তখন আমি হয়তো বড়োজোর তিন বা চার বছরের, বাবা ও মায়ের সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছি “দেবদাস” কিছুই বুঝতে পারিনি, অবাক হয়ে শুধু সামনের সাদা পর্দার উপর অবিরত বিভিন্ন দৃশ্যায়ন দেখছি। কিন্তু আজও মনে আছে একটি দৃশ্য ধুতি পাঞ্জাবি পরা একজন হারমোনিয়াম নিয়ে গেয়ে চলেছেন ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’, গানটি বারবার আজও ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে।সেই বয়সে জানতেও পারিনি যে দীঘল চোখের ছবির মানুষটি এই গানটি লিখে গেছেন।
ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ‘কিশলয়’ তে প্রথম আলাপ আমার দুখু মিঞার সাথে। অপরিসীম দুঃখের মধ্যেই কিভাবে দুখু মিঞার বাল্যকাল কেটেছে তা পড়ে ছোট্ট মন ব্যথায় ভোরে উঠতো। ভীষণ কৌতূহলও হয়েছিল যখন দেখি মাত্র এগারো বারো বছর বয়সেই ‘লেটো’ দলে যোগ দেন। আবার এই বয়সেই দারিদ্র্য কে হার মানাতে এক রুটির দোকানে মাসিক এক টাকা বেতনে চাকরি করেন। ‘কিশলয়’ এর পাতা থেকে তাই দুখু মিঞা কে কখন যেন নিজের করে ফেলেছিলাম। জেনে গিয়েছিলাম মামাবাড়িতে দেয়ালে থাকা ছবিতে যে বড় বড় দীঘল চোখের অধিকারী তিনি আমার ‘কিশলয়’ এর সাথী দুখু মিঞা। প্রাথমিক স্কুলেই পা মেলাই নাচের ছন্দে ‘চল্ চল্ চল্ উর্দ্ধগগনে বাজে মাদল’ স্কুলেরই নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের শেখানো ‘লিচুচোর’ এর ছন্দে বারবার আন্দোলিত হই।
আবারও চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় চমক লাগে:
বিস্ময়ে ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে ‘–বারবার কবিতাটি পড়ি, বড় বিস্ময় জাগে এই লেখক সম্পর্কে। ওনার লেখা আর কিছু কবিতার সন্ধান যদি পাই ভেবেই বাড়িতে বাবার বইয়ের লাইব্রেরী হাতড়াই সারাক্ষন।
অবশেষে পেলাম একটি সঙ্গীত শিক্ষার বই, ‘নজরুল গীতি’। —বইটি সারাদিন কাছে রেখে একের পর এক পাতা ওল্টাই — বইটির দ্বিতীয় পাতাতেই তো বাঁশি হাতে — নিমীলিত চোখে আমার সেই কিশলয়ের সাথী দুখু মিঞা। বিস্ময় জাগে এত গান সব ওনার লেখা !!! এক নিঃশ্বাসে পাতা ওল্টাতে থাকি — তিন চার পাতার পরই গীতিকারের নিজের হাতের লেখায় দুটি বিখ্যাত গান ‘মোমের পুতুল’ ও দূরদ্বীপবাসিনী। ঐ ছোট্ট বয়েসেও কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পাতা উল্টে গান গুলি দেখতে থাকি।
আবার ফিরে আসি বাবার লাইব্রেরিতে – এত রাশি রাশি বিভিন্ন বই এর মধ্যে আমি খুঁজে বেড়াই যদি কোনো কবিতার বই পাই— বাবাকে বলাতে দুটো বই পেলাম বাবার লাইব্রেরী থেকে ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘সঞ্চিতা’।
সবে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি -অগ্নিবীণার সব কবিতা হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা ছিল না আমার তবু আজ ও মনে পড়ে অগ্নিবীণা তে ছিল বিদ্রোহী, প্রলয়োল্লাস, কামাল পাশা, কোরবানী ইত্যাদি। বাবা ভরাট গলায় আবৃত্তি করে শোনাতেন বিদ্রোহী, শুনতে শুনতে অদ্ভুত এক শিহরণ লাগতো। সব বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না কিন্তু অদম্য এক ভালোলাগায় গা শিহরিত হয়ে উঠত। শৈশবের গণ্ডী পেরিয়ে সদ্য কিশোরী আমি কখন যে মনের ভেতর বিদ্রোহী কবি তাঁর আয়ত চক্ষুর অতলস্পর্শী দৃষ্টি দিয়ে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে আমাকে ছুঁয়ে গেছেন জানতে ও পারিনি। সময় পেলেই অগ্নিবীণা আর নজরুলগীতি বই দুখানি নিয়ে বসতাম। বারবার বিদ্রোহী কবিতাটি পড়তাম —
তাঁর বীররসের কবিতা বিদ্রোহীতে আছে,
‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ চিহ্ন।’ কিংবা ‘আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব’
‘বিদ্রোহী’ তে একালের মানুষের বিদ্রোহ যেন বাণীরূপায়িত হয়েছে। এই কবিতায় সামিল-মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার হয়েছে। এই ছন্দে বীররস প্রকৃত প্রকাশ পেয়েছে। সেই কিশোরী বয়সে ভাবতাম কবি নজরুল মানেই বোধহয় বিদ্রোহ – তেজোদীপ্ত – সব নিয়মের বেড়াজালে ভেঙে ফেলা, ছক ভাঙা এক ব্যাক্তিত্ব। ভুল ভাঙলো প্রেমিক, দেশভক্ত কালজয়ী, বিরহী নজরুলকে খুঁজে পেয়ে।
একদিকে বিদ্রোহীর কলমে ফুটে ওঠে,
বল বীর
‘চির উন্নত মম শির
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির দুর্জয়’
সেই নজরুলই প্রেমিকরূপে ‘বিজয়িনী’ তে লেখেন
‘হে মোর রানী! তোমার কাছে
হার মানি আজ শেষে,
আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার
চরণ তলে এসে।।
আজ বিদ্রোহীর এই রক্তরথের চুড়ে
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর
আঁচল তোমার উড়ে।
আবার এই প্রেমিকসত্বা বারবার তাঁর বিভিন্ন কবিতা ও গানে খুঁজে পাই হারিয়ে যায় বিদ্রোহী কবি প্রেমের জোয়ারে
‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী,
দেব খোঁপায় তারার ফুল।’
সত্যি তিনি প্রেমের সুরসাধক তাই অক্লেশে বিদ্রোহীসত্বা সরিয়ে মেলে দিতে পারেন প্রেমের ডানা বলতে পারেন
‘সই, ভালো করে বিনোদ বেণী বাঁধিয়া দে,
মোর বঁধু যেন বাঁধা থাকে বেনীর ফাঁদে।’
কিশোরী বয়সে সেই ভালোবাসার দুর্বার টানে আকর্ষিত হয়ে পড়ি কবি কে ভালো করে জানার চেনার আমার মতো করেই। তখনই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি কবির গানে একদিকে শ্যাম ও শ্যামার বন্দনা গীতি। আবার অন্যদিকে আল্লার প্রতি প্রীতিবন্দনা। একদিকে তাঁর হজরত মহম্মদ প্রীতি অন্যদিকে কীর্তন, গজল, ঝুমুরের সুরঝংকার।
কবি একদিকে যখন বলছেন
‘আমি আল্লা নামের বীজ বুনেছি’
কিংবা ‘মসজিদে ওই শোন্ রে আজান্ চল্ নামাজে চল্’
আবার শ্যামবন্দনায় তিনি লিখলেন:
‘হে গোবিন্দ রাখো চরণে’
কিংবা ‘সখি, যে হরি কেমন বল্’
অথবা ‘গোঠের রাখাল, বলে দে রে কোথায় বৃন্দাবন’।
বিদ্রোহী কবি এমন সত্বা যেখানে আল্লা ও শ্যাম মিলেমিশে যান এক হয়ে। শ্যামাবন্দনায় যিনি নিবেদিত প্রাণ-
‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা
আলোর নাচন’।
কিংবা ‘মা তোর কালো রূপের মাঝে
রসের সাগর লুকিয়ে আছে’।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষিত হই কবিচরণে, সবে নবম শ্রেণী তখন আমার। পাঠ্যপুস্তকেই বিদ্রোহী কবির পরপর দুটি কবিতা ‘ছাত্রদলের গান’ এবং কান্ডারি হুঁশিয়ার। একদিকে যখন ছাত্রদলের যৌবন রক্তে প্রলয় নাচন লাগে কবির ছন্দে-
‘আমরা শক্তি, আমরা বল
আমরা ছাত্রদল,
মোদের পায়ের তলায় মুর্ছে তুফান,
উর্দ্ধে বিমান ঝড় বাদল।
এই সুর এই ছন্দ তরুণ ছাত্রদলের মানসলোকে দুর্গম পথের স্বপ্নাঞ্জনে বিস্তার করেছে, এই গতিবাদী জীবনের মোহন রণবেশ – পথে চলার মধুর আহ্বান ছাত্রদলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে বীরের বজ্রহুংকার। কবি তাঁর সহজাত কবিত্বশক্তিতে আপন বিচিত্র বিকাশের বিন্যাসে প্রকাশ করেছেন ছাত্রদলের বীরত্ব শক্তি।
আবার একই সাথে এই দুর্গম যৌবনশক্তির চির বিদ্রোহী কবি জাতীয় দুর্দিনে বারবার বিশ্ব ভাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় লেখেন,
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সম্বরণ
কান্ডারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপন
“হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোরমার।
কিংবা “জাতের নাম বজ্জাতি সব-
জাট জালিয়াত খেলছ জুয়া”।
আবার একই সাথে, মানুষের আত্মবোধ জাগ্রত করতে পরমসত্বা সম্পর্কে সচেতন করতে, সর্বপ্রকার সমাজ সাম্যের প্রতিষ্ঠা করতে লেখনি ধরেন “এক সে আকাশ মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শশ্মানে ঠাঁই
একই রক্ত বুকের পরে এক সে নাড়ীর টান”।
আমাদের বাড়িতে তখনও টেলিভিশন আসেনি, তাই রেডিও শোনার প্রবণতা ছিল আমার, বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নাটক শুনতাম খুবই। আমি তখন দশম শ্রেণীতে পড়ি, শুনলাম নাটক ‘শিউলি মালা’ অনবদ্য একটি রোমান্টিক কাহিনী। শেষ দৃশ্যে হৃদয় মোচড় দিয়ে ওঠে। বাবার বইয়ের লাইব্রেরি থেকে নজরুল রচনাসম্ভার চেয়ে নিই। কবি নজরুল এই গল্পটির উপসংহারে লিখেছেন “শিউলি ফুল বড় মৃদু,বড় ভীরু।” গলায় পরলে দু’দন্ডে আউড়ে যায়। তাই শিউলিফুলের আশ্বিন যখন আসে, তখন নীরবে মালা গাঁথি আর জলে ভাসিয়ে দিই”। বিস্মিত হয়, রোমাঞ্চ লাগে সারা শরীরে এ কোন বিদ্রোহী কবি যাঁর সকল বিদ্রোহের অবসান ঘটে ভরপুর রোমান্টিকতায় !!! যাঁর স্বঘোষিত বজ্রনিনাদ বলে: “আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’ তিনি আবার প্রিয়ার কাছে ধরা দেন অভিমানীরূপে
“আমি চিরতরে দূরে সরে যাব
তবু আমারে দেব না ভুলিতে”।
কবি নজরুলের এই ভিন্নসত্বা আমায় ছুঁয়ে যায় বারবার। প্রায় সাড়ে তিনহাজার গানের মধ্যে, ঠুংরী, গজল গানের যে সূক্ষ্ম সুরের কারুকার্য তা সকল সংগীত প্রেমীর চিত্ত রঞ্জিত করে। কবির বিভিন্ন গানে বেশ কিছু আরবী, উর্দু, ফারসী মিশ্রিত শব্দের ব্যবহার গানগুলিকে এক অনন্য মাত্রা দেয়।
*******