নিজস্ব সংবাদদাতা: গত ৯ই আগষ্ট বিয়ে আর ঠিক সেই ৯ই সেপ্টেম্বর সব শেষ! ভাবতেই পারছেনা বিদ্যাসাগরপুর। ভাবতেই পারছে ইন্দার অঙ্কুশ ক্লাবের সদস্যরা! এই তো ১৬ই আগষ্ট ক্লাবের জন্ম দিনে একটা মস্ত বড় কেক কেটেছিল ছেলেটা। আকাশ ভেঙে পড়েছে সারা খড়গপুর শহরের। আপাদমস্তক পরোপকারি, হাসিখুশি রাজা(এ নামেই এলাকায় পরিচিত) আর নেই! বুধবার রাত ৭টা নাগাদ শালবনী করোনা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে রাজা। ঘটনার মাত্র ১ঘন্টা আগেই খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালের সেফ হোম থেকে করোনা মুক্ত হয়ে ফিরেছেন রাজার মা। খড়গপুর শহরে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে গত ১৯টি মৃত্যুর পর এই ২০তম মৃত্যু এই শহরের জন্য একটি মারাত্মক সতর্কতা বয়ে এনেছে কারন মধ্য মাত্র মধ্য তিরিশেই মৃত্যু হয়েছে এই যুবকের। যতদুর আমরা জানতে পারা গেছে তা’হল রাজার বয়স হয়েছিল ৩৭ বছর। এত কম বয়সে সম্ভবত জেলাতেও খুব কম মৃত্যু হয়েছে।
রাজার মৃত্যু তাঁর সংসারে দুটি নারীর জন্য হাহাকার রেখে গেল। একজন তাঁর মা যিনি তাঁর একমাত্র সন্তানকে হারালেন আর আরেকজনের জন্য এই মৃত্যু স্বান্তনারও অতীত, রাজার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, যে বিয়ের বয়স হয়েছিল একদম ঠিক একমাস । লকডাউনের মধ্যেই আনলক ইন্ডিয়ার চতুর্থ পর্বে বিয়ে করেছিলেন রাজা। রাজার মা খড়গপুর পুরসভার স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন, রাজা নিজেও মায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জানা গেছে ১২দিন আগে রাজার মা করোনা আক্রান্ত হন। পুরসভার আওতায় বাড়ি বাড়ি কোভিড সার্ভে, কোভিড রোগিদের বাড়িতে গিয়ে পরামর্শ দেওয়া, ওষুধ দেওয়ার কাজ করতেন। সম্ভবত সেখান থেকে আক্রান্ত হন তিনি।
রাজার বন্ধুরা জানিয়েছেন, রাজার মাকে যেদিন খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালের সেফ হোমে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন স্বাস্থ্যদপ্তরের আ্যম্বুলেন্সের পেছনে পেছনে বাইকে করে মাকে ছাড়তে গেছিলেন রাজা। খুব আগে বাবাকে হারিয়েছিলেন তাই মা-ই সব ছিল তাঁর, মায়েরও তাই। মায়ের কষ্ট লাঘবের জন্যই লকডাউনের মধ্যে বিয়ে। কয়েকদিন পরে নিজেও আক্রান্ত হন। কয়েকদিন ভালই ছিলেন। মৃদু উপসর্গ থাকায় ছিলেন খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালের সেফহোমে। কিন্তু মঙ্গলবার অবস্থা একটু খারাপ হয়, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এরপর তাঁকেও নিয়ে যাওয়া হয় শালবনী হাসপাতালে। বুধবার সব শেষ।
বুধবার প্রায় ১১দিনের মাথায় করোনা নেগেটিভ হয়ে বাড়ি ফেরেন রাজার মা। আসার আগে ছেলের সঙ্গে মোবাইলে কথাও বলেন। বন্ধুরা জানিয়েছেন দুপুরেও তাঁদের কারও কারও সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রতিদিনের মত কথা বলেছেন নবপরিনীতা স্ত্রীর সাথেও। বিয়ের মাস ফুরানো দিনটি বলে কথা! কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। অক্সিজেন দেওয়া হয় কিন্তু শেষ অবধি রক্ষা হয়নি। রাত ৮টা নাগাদ মৃত্যু হয় তাঁর। সেই খবর এসে পৌঁছানোর পর স্তব্ধ হয়ে যায় খড়গপুর শহরের ইন্দা এলাকা। শোকে ভেঙে পড়েছেন তাঁর প্রিয় অঙ্কুশ ক্লাবের সদস্যরা। এই মারাত্মক দুঃসংবাদ কী ভাবে তাঁর পরিবারে পৌঁছানো যাবে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা।
এই মৃত্যু ফের প্রশ্ন তুলে দিয়েছে শালবনী করোনা হাসপাতালের ভুমিকা নিয়ে। রাজার মৃত্যুর মাত্র ২৪ ঘন্টা আগেই হাসপাতালের আব্যবস্থার কারণেই সুপারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। গত ৪৫দিনে ৩০টি মৃত্যু হয়েছে শালবনী করোনা হাসপাতালে আর শুধু আগষ্ট মাসেই মৃত্যু হয়েছে ১৯জনের। খড়গপুরের এই তরতাজা যুবকের মৃত্যু ফের একবার আঙুল তুলে দিল করোনা হাসপাতালের পরিষেবার প্রতি। খড়গপুর শহরের মন্দিরতলা শ্মশানেই বৈদ্যুতিক চুল্লিতে দাহ হবে খড়গপুরের প্রিয় সন্তানের দেহ। খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালের সেফ হোমে মা কে ছাড়তে যাওয়ার সময় ছেলে বলেছিল, চিন্তা করোনা ফিরিয়ে আনব তোমায়। মা ফিরল, ছেলে ফিরলনা।