নিজস্ব সংবাদদাতা: ৩৬৪ দিন যদি লালুর হয় তো ১দিন সুজনের। আর সেই দিনটাই ছিল বুধবার। বুধবার রাতভর সুজনের কোলেই কাটল লালুর। খড়গপুর রবীন্দ্রপল্লীর ৩৩নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সুজনদের বাড়ি উঠোন জলে একাকার। রাস্তার সামনে নর্দমা কতকাল পরিষ্কার হয়নি কারও মনে নেই। সেই নালা দিয়ে নামছেনা জল। রাতভর বৃষ্টিতে সেই জল নালা উপচে ঢুকে পড়েছে সুজনদের উঠোন পেরিয়ে ঘরের লাগোয়া। আর তার মধ্যেই দেখা গেল বিপদে পড়েছে লালু। লালু একা নয়, লালুর পাশাপাশি রয়েছে কালু, টুসি, রিমা সহ গোটা পাঁচ-ছয়েক কুকুর।
দিনভর এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালেও সন্ধ্যার পর থেকে সুজনদের বাড়ির সামনে কালভার্টের ওপর বসে চলে কড়া প্রহরা। রাধাগোবিন্দ জিউর মন্দির থেকে শুরু করে যে রাস্তা শিবমন্দির বরাবর আইআইটি বাইপাশে উঠে গিয়েছে সেই রাস্তায় সুজন ও তার আশেপাশের ১০/১২টি বাড়ি আর ২টা গলির পাহারাদার লালুর দল। যাদের জন্য নিশ্চিন্তে ঘুমায় সুজনরা।
ভারী বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত খড়গপুর শহরের। বিশেষ করে শহরের নিচু এলাকা গুলির অবস্থা খুবই খারাপ। গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে সংস্কার হয়না কাঁচানালা। বর্ষার আগে নিয়মকরে নালা সংস্কার আর আগাছা পরিষ্কার করা এখন ইতিহাস। সেই অব্যবস্থাপনার সুযোগে বৃহস্পতিবার রাতভর তুমুল বৃষ্টিতে পর্দা ফাঁস পৌরসভার। বুধবার রাত ১০টা থেকে শুরু হওয়ায় ভারী বর্ষণ চলেছে বৃহস্পতিবার ভোর অবধি।
শহরের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের ঘরের উঠোন থেকে শুরু করে বেড রুম অবধি জলে জলাকার। মানুষ না’হয় খাটের ওপরে উঠে পা বাঁচিয়েছে কিন্তু গৃহপালিত পশুগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। জলে পা ডুবিয়ে, গা ডুবিয়ে রাত কাটাতে হয়েছে আশ্রয় হীন রাস্তার কুকুর বেড়াল কে। কিন্তু ভাগ্যবান লালু, রাত ভর তাকে নিজের কাছেই রেখেছিল সুজন।
সুজন জানিয়েছে, “রাত ১০টা থেকে শুরু হয়েছিল বৃষ্টি। ১২টা অবধি তারই মধ্যে রাস্তায় পাহারায় ছিল লালুরা। রাত ১২টার পর আশেপাশের এলাকায় জল জমতে জমতে ক্রমশ তা বড় রাস্তায় উঠে আসে। বড় নালাটা আর জল ঠেলতে পারছিলনা। আমাদেরও উঠোন উপচে জল ঘরে ঢোকার উপক্রম হয়। ভয়ে ঘুমোতে পারছিলাম না আমরাও। বারবার বাইরে উঁকি মেরে দেখছি জল বেড়েই চলেছে। এই সময় লক্ষ্য করি বাকি কুকুররা এদিক ওদিক সরে পড়লেও লালু তখনও রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে। রাস্তায় তখন জল উঠে পড়ে নদীর মত স্রোত নামছে কিন্তু লালু তখনও আমাদের বাড়ির গেট আগলে বসে রয়েছে বৃষ্টির মধ্যেই। বুঝতে পারি আর কিছুক্ষন এভাবে থাকলে ভেসে যেতে পারে লালু আর একবার ভেসে কালভার্টের তলায় পড়ে গেলে ওকে বাঁচানো অসম্ভব। বড় নালা ওকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে ফেলবে ৫০০মিটার দুরে রেল লাইনের কাছাকাছি।”
এরপরই লালুকে কোলে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে আসে সুজন। সেই থেকে সারা রাত সুজনের কাছেই ছিল লালু। মাঝে মাঝে ভীষন জোরে বাজ পড়ার শব্দে কেঁপে উঠেছে লালু কিন্তু তারপরই নিশ্চিন্তে মাথা গুঁজে দিয়েছে সুজনের কোলেই। একেবারেই নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে সুজন। বাবা তুলসি দে একসময় দিন মজুরির কাজ করতেন কিন্তু এখন আর শরীরে কুলায়না। বাড়িতে সামান্য একটা তেলে ভাজার দোকান, সন্ধ্যার পর খোলে। তাও লকডাউনে সে দোকানের দফারফা। ফলে সংসার যেন চলতেই চায়না সুজনদের।
কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর কাজ জোটেনি সুজনের। কখনও ক্যাটারার বয়, কখনও এদিক ওদিক খেটে দু’তিনশ যা মেলে তাই দিয়ে কষ্টের সংসার। বাড়ি নয়, মনটা অনেক বড় সুজনের। পাড়ায় যেকোনো মানুষের বিপদে আপদে ছুটে যায় সুজন আর তার বন্ধুরা। ক্যাটস আই সুজনকে বন্ধুরা তাকে ‘কটা’ বলেই ডাকে। সেই কটার কোলে সকাল বেলায় দুর্যোগ মুক্ত সকাল দেখছে লালু। পাড়ার ছোট ছেলেরা তাই দেখে চিৎকার করে বলছে, কটাদা জিন্দাবাদ!