বর্ণময় পুরুষকার: মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিনোদ মন্ডল
সমসময়ের সমাজ ও রাজনীতিতে যখন লোভী ভোগী ও ত্যাগীদের ঢক্কানিনাদে আমজনতার কানের চাম ফেটে যাওয়ার দশা, তখন দুই শতাব্দি দূরের এক জ্যোতিষ্কের সন্ধান পাওয়া যায়–যিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৫ মে ১৮১৭ — ১৯ জানুয়ারি ১৯০৫)। যাঁর জীবনে জগৎসংসারের তুরীয় আসক্তি অনাসক্তি ও বীতস্পৃহার স্ফুরণ পরিলক্ষিত।
ইতিহাস তাঁকে মনে রেখেছে রবীন্দ্রনাথের পিতা হিসাবে, এটাই আজকের নিষ্ঠুর সত্য। কিন্তু এই অবমূল্যায়ন তাঁর আপ্তি ছিল না। যেকোনো অনুসন্ধিতসু পাঠক জানেন দ্বারকানাথ(পিতা) ছিলেন তাঁর জ্যাঠামশাই রামলোচন ও জেঠিমা অলকাসুন্দরীর দত্তক পুত্র। এই ঠাকুরমা অলকাসুন্দরীর প্রবল প্রভাব পড়েছে দেবেনের উপর। তিনি ছিলেন পৌত্তলিক ও ধর্মপরায়ণা বিদুষী।ঠাকুরবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোর আড়ম্বরতা ও ভাসানের শোভাযাত্রা ছিল সেকালের কলকাতার অন্যতম দ্রষ্টব্য ও আলোচ্য বিষয়। পিতা দ্বারকানাথ বিলাস ব্যসনে ও বিষয় ভাবনায় মজে থাকতেন সবসময়। অন্যদিকে রামমোহন রায়ের সান্নিধ্য ও তাঁর পৌত্তলিকতা বিরোধী মানসিকতায় প্রভাবিত ও আবিষ্ট হন দেবেন্দ্রনাথ। ফলে বিচিত্র বিপরীতধর্মী চোরা টানে তাঁর জীবন বর্ণময় ও বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। তিনি যেন রাজসন্ন্যাসী।
দেবেন্দ্রনাথের চারটি প্রতিকৃতি গবেষকমহলের সন্ধানীদৃষ্টিতে বিশ্লেষিত হয়। এঁকেছেন সেকালের চার বিখ্যাত চিত্রকর। প্রথম তিনজন বিদেশি। এক) উইলিয়াম বিচির আঁকা ছবিতে কিশোর দেবেন্দ্রনাথ চিত্রিত। বহুমূল্য পোশাকে ভূষিত রাজপুত্র। দুই) মার্শাল ক্ল্যাকস্টনের তুলিতে বাবু দেবেন্দ্রনাথের ভাবমূর্তি প্রতিফলিত। তিন) উইলিয়াম আর্চারের আঁকা ছবিতে তিনি যেন এক প্রৌঢ় সন্ন্যাসী। প্রশান্ত ব্যক্তিত্বের উদ্ভাসে চোখ জুড়িয়ে যায়। চার) অবন ঠাকুর — একমাত্র দেশীয় চিত্রকর – যাঁর আঁকা ছবিটির মধ্যে বৃদ্ধ দার্শনিক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এর ধীর-স্থির প্রজ্ঞার ছাপ পরিলক্ষিত হয়।
প্রতিকৃতি তো জীবনের জলছবি। অতুল বৈভবে মানুষ তিনি। বছর তিনেক বাড়িতে শিক্ষালাভ। পরে ১৮২৭ নাগাদ রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো হিন্দু কলেজে যাতায়াত করেছেন। তারপরই বাবার ব্যবসা ও বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনায় যুক্ত হচ্ছেন। মেতে যাচ্ছেন। ১৮৩৮ এ পিতামহীর মৃত্যু তাঁকে নাড়া দেয় প্রচণ্ড। তার দশ বছর পরে বিলেতে পিতার মৃত্যু অকূলপাথারে নিক্ষেপ করে। এই মধ্যবর্তী সময়ে মহাভারত, উপনিষদ, বেদ গুলি খুঁটিয়ে পড়ছেন তিনি। পড়ছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের নানা মত ও চিন্তার ভাষ্যাবলি। ধীরে ধীরে ভোগবিলাস থেকে সরে যাচ্ছে মন। পার্থিব বিষয়ে বীতস্পৃহ হয়ে উঠছেন ক্রমশ; তীব্র হচ্ছে ঈশ্বর আকাঙ্ক্ষা।
মৃত্যুর পর তিনি কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হলেন। বিস্তারে জানলেন — এক কোটি টাকা দেনা মাথায়। শপথ নিলেন মনে মনে — পিতৃঋণ শোধ করবেন তিনি। করেছেনও। তখন ধীরে ধীরে বিক্রয় করলেন কয়লা খনি, রেশমকুঠি, নীলকুঠি, চিনির কারখানা। এমনকি ঠাকুরবাড়ির নানা মহার্ঘ আসবাবপত্র। দ্বারকানাথ বিভিন্ন ট্রাস্টের হাতে একটা বড় অংশ উইল এর মাধ্যমে দান করে যান। তিনি তার অধিকাংশ অছি বিনিময় করে দেন। তাতেও সর্বসাকুল্যে ৪০ লাখ পাওয়া যায়। শুরু করলেন ব্যয় সংকোচন।কাঁটা চামচ টেবিল-চেয়ার কার্পেট ছেড়ে নেমে এলেন ডাল- রুটিতে। কম্বল মাদুর শীতল পাটিতে। বন্ধুরা দেখা করতে এলে মেঝেতে বসেই সম্মিলন শুরু হল। এছাড়াও দ্বারকানাথ বহু ব্যক্তি ও পরিবারকে বৃত্তি মাসোয়ারা দিতেন। সে সবও চালিয়ে গেলেন তিনি। পিতার প্রতিশ্রুতি ভাঙতে দেননি। কনিষ্ঠপুত্র রবীন্দ্রনাথ এই পারিবারিক বিপর্যয়ের দিনগুলিতে বড় হচ্ছেন। ফলে মিত ব্যয় ও কৃচ্ছ্রসাধনে ভরা জীবনের পাঠ গ্রহণ করেছেন বাবার কাছ থেকে।
মহর্ষি যে আত্মজীবনী লিখে যান, তাঁর জীবদ্দশায় তা প্রকাশে নিষেধ ছিল। তাই প্রকাশ করা হয়নি। ফলে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনী বাংলা ভাষায় প্রথম আত্মজীবন চরিত হিসেবে গণ্য হয়। মহর্ষির লেখায় তাঁর জীবনের নানা দিগন্তের সন্ধান পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ সে বিষয়ে বিশদে নানা স্থলে বর্ণনা করে গেছেন। আশ্রমের শিক্ষক অজিত কুমার চক্রবর্তী ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন বৃত্তান্ত’নামে যে আকর গ্রন্থ রচনা করে গেছেন তা ১৯১৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। মহর্ষি অনুচর প্রিয়নাথ শাস্ত্রী অন্য একটি মূল্যবান কাজ ১৯০৯ সালে সম্পন্ন করেছেন। তা হল ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্রাবলী’ শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনা। বিস্ময়ের অন্ত থাকে না, বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে মহর্ষি ৬০০ এর বেশি চিঠি লিখেছিলেন। জীবনের নানা টানাপোড়েনে, আত্ম ভাবনার গভীর প্রশ্নাবলি এইসব পত্রের ছত্রে ছত্রে প্রতিফলিত।
বাস্তবে তাঁর সম্পর্কে শিক্ষা প্রসারক, দার্শনিক, সমাজসেবী, চিন্তক, রাজনীতিবিদ এইসব নানা বিশেষণ ব্যবহৃত হলেও আসলে জীবনের স্বর্ণ সময় তিনি ব্যয় করেছেন ধর্ম প্রচারক হিসেবে। নানা তথ্য নিয়ে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার জন্য তিনি তত্ত্বরঞ্জনী সভা (১৮৩৯) স্থাপন করেন।এই তত্ত্বরঞ্জনী সভার উদ্দীপক হলো তত্ত্ববোধিনী সভা। এই সময়ে কঠোপনিষদের বাংলা অনুবাদ সেরে ফেলেছেন দেবেন্দ্রনাথ। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে মহর্ষি তত্ত্ববোধিনী সভা ও ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বভার নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। ১৮৪৩ সালে বন্ধুপ্রতিম শিষ্য অক্ষয় কুমার দত্তের হাতে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব তুলে দিচ্ছেন। এ এক যুগান্তকারী ঘটনাও বটে। চালু হচ্ছে পত্রিকার জন্য বৃত্তি প্রদান। নিজে সেখানে ধারাবাহিকভাবে উপনিষদের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে নিছক তত্ত্বের কচকচিতে মত্ত না থেকে বিজ্ঞান, সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির নানা প্রান্ত নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী মননশীল লেখা প্রকাশ করে চলেছেন অক্ষয় কুমার। নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন অন্তরঙ্গ বিদ্যাসাগর মশাই।
চালু হলো প্রকাশ্যে বেদপাঠ রীতি। প্রণীত হল ব্রহ্মোপাসনা পদ্ধতি (১৮৪৪)। ১৮৪৫ এ তা লাগু হচ্ছে ব্রাহ্মসমাজে। দীর্ঘ শাস্ত্র চর্চার পর উপলব্ধি করেন শুধু উপনিষদ নয়, বেদের শূক্ত থেকেও ব্রাহ্ম ধর্মের ভিত্তি সূত্র চয়ন করতে হবে। ১৮৪৮ থেকে ঋগবেদের অনুবাদ কার্য শুরু করলেন। যা ‘ব্রাহ্মধর্ম’ গ্রন্থের রূপ নিয়েছে (১৮৬৯)। এর আগে আত্মতত্ত্ব বিদ্যা (১৮৫০) নামক গ্রন্থটি সমাজে তরঙ্গ তুলেছে। ১৮৫৬ তে তত্ত্ববোধিনী সভার সম্পাদক হচ্ছেন স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ। ১৮৫৯ সালে স্থাপন করেছেন ব্রাহ্ম বিদ্যালয়। পূজা বন্ধ করে ‘মাঘ উৎসব’, ‘নববর্ষ’, ‘দীক্ষাদিন’ প্রভৃতি দিকে বাঁক নিচ্ছে ধর্ম আন্দোলন। বীরভূমের ভুবন ডাঙ্গাতে বিশাল এলাকা কিনে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন ১৮৬৭ সালে। যা আজকের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। শান্তিনিকেতন। ধর্মপ্রচারক দেবেন্দ্রনাথ হিন্দু চ্যারিটেবল ইনস্টিটিউশনের বেথুন সোসাইটির কাজে অন্যদের সাথে, কাজে লাগছেন। তাই সেকালের অন্যতম সমাজপতি রাধাকান্ত দেব ১৮৬৭ সালে তাঁকে ‘জাতীয় ধর্মের পরিরক্ষক’ অভিধায় ভূষিত করেছেন। ব্রাহ্মসমাজ তাঁকে ‘মহর্ষি’ উপাধি প্রদান করেছে। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতের রেকর্ড থেকে জানা যায় মথুরবাবুকে সঙ্গে নিয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান রামকৃষ্ণ। প্রথমে দ্বিধা থাকলেও পরবর্তীকালে সহজ হয়ে ওঠেন দেবেন্দ্রনাথ। ঠাকুরকে বেদ ব্যাখ্যা করে শোনান, ব্রাহ্ম সমাজের উৎসবে সাদর আমন্ত্রণ জানান। ঠাকুরও তাঁকে ‘কলির জনক’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন পরে।
পৈতৃক ব্যবসার নানা দায়িত্ব পালনের ফাঁকে শুধু অধ্যাত্ম চর্চা নয়, গভীর সমাজসেবায় নিয়োজিত ছিলেন মহর্ষি। ১৮৫১ সালের ৩১ অক্টোবর যে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি ছিলেন তার প্রথম সম্পাদক। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়,ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতবর্ষীয়দের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে পত্র পাঠান দেবেন্দ্রনাথ। দরিদ্র গ্রামবাসীদের জন্য চৌকিদারি কর মকুবের আপ্রাণ প্রচেষ্টা ছিল তাঁর। বিধবা বিবাহ প্রচলনএ উৎসাহী এবং বাল্য ও বহুবিবাহ বিরোধী মানুষ ছিলেন তিনি।
বর্ণময় মানুষটি ঘোষণা করেছেন অকপটে — ‘আমি বিলাসের আমোদে ডুবিয়া ছিলাম’। তদানীন্তন সমাজের দান ধ্যান, উৎসব অনুষ্ঠান, সেবা সমিতির জন্য বাবু খ্যাতি রটে যায় তাঁর। যৌবনে খাবার টেবিলে সাহেবি কেতায় প্রতিদিন মদ্যপান অভ্যাস ছিল তাঁর। পরবর্তীকালে এই মানুষটি ঋষিকল্প জীবন যাপন করেছেন। ‘চারিত্রপূজায়’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – ”আমার অভিজ্ঞতার মধ্যেই দেখেছি, অনেক শোকাবহ ব্যাপারে, আত্মীয়-স্বজনের বিয়োগ বিচ্ছেদে, তিনি তাঁর সেই তেতলার ঘরে আত্মসমাহিত হয়ে একা বসে আছেন। কেউ সাহস করতো না তাঁকে সান্ত্বনা দিতে। বাইরের আনুকূল্যের তিনি কোনদিনও অপেক্ষা রাখেননি; আপনি আপনার মধ্যে আনন্দ পেতেন।”