উইলিয়ম কেরিবিনোদ মন্ডল রবীন্দ্রনাথের একশো বছর আগে জন্মেছেন। সুদূর লন্ডনের একটি গন্ডগ্রামে। রামমোহনের মৃত্যুর পরের বছর মারা গেলেন। রামমোহনের জন্মস্থানে। রামমোহন মারা যাচ্ছেন ব্রিস্টলে। তিনি একজন ব্রিটিশ নাগরিক। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধামাধরা ছিলেন না বরং কোম্পানির চোখে ফাঁকি দিয়ে এদেশে আসেন সপরিবারে। ডেনিশ কলোনিতে বসবাস শুরু করেন। তারপর নানা ক্ষেত্রে বিচরণ করতে করতে নিজে এক ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছেন। তিনি উইলিয়াম কেরি (১৭.০৮.১৭৬১— ০৯.০৬.১৮৩৪)।
১৭৯৩ -এর ১৩ জুন লন্ডন থেকে রওনা হন। নভেম্বরে এ দেশে পদার্পণ। আমৃত্যু, চার চারটি দশক মানুষের জন্য কাজ করে প্রয়াত হন। পৃথিবী জোড়া স্বীকৃতি পেয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় উইলিয়াম কেরি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ইন পাসাডেনা, আবার অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে, ভ্যানকুভার, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে, এমনকি বাংলাদেশের চট্টগ্রামেও উইলিয়াম কেরি একাডেমি গঠিত হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস উদাসীন বাঙালি আমরা এখনও তাঁর স্মৃতিকে অমলিন রাখতে যোগ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারিনি।
কেন গড়ে তুলতে হবে? একজন শ্বেতকায় ধর্মপ্রচারকের জন্য? নীলকর সাহেবদের সহযোগী এক তাঁবেদারের জন্য ? না। আমরা মনে রাখতে চাই ধর্মপ্রচারক কেরিকে নয়, সমাজ সংস্কারক কেরিকে। যিনি রামমোহনের অনেক আগে এদেশে দাঁড়িয়ে সতীদাহের মতো মানবতাবিরোধী বর্বরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। আইন প্রণয়নের জন্য সওয়াল করেছিলেন। মনে রাখতে চাই শিক্ষা সংস্কারক কেরিকে।
তখন ডেনমার্ক সরকারের অধীনে ছিল শ্রীরামপুর শহর। ডেনমার্কের রাজা মিশনারীদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। তাই তিনি সেখানে ওঠেন। ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে এখানে বসবাস শুরু করেন। তার আগে ৬ বছর কাটান মেদিনীপুরে। ইতিমধ্যে বাংলা শিখে নিয়েছিলেন রামরাম বসুর কাছে। যিনি তাঁর সঙ্গে পরে সহশিক্ষক পদে যুক্ত হবেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। বাংলা গদ্য তখন মুখের ভাষা মাত্র। লেখ্য সম্পদ বলতে বাংলায় কিছু কাব্য কবিতা, দলিল-দস্তাবেজ, দরকারি বেদরকারি চিঠিপত্র, সনদ সোপর্দ। ছাপাখানা তৈরি হলে কী ছাপা হবে ? ছাপার জন্য রসদ নেই উপযুক্ত। বাংলা ভাষা ও তার গদ্যকে লালন করতে তার শৈশবেই এগিয়ে এলেন সাগরপারের সাহেব।
একটি তন্তুবায় পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা এডমন্ড কেরি। মা এলিজাবেথ। দরিদ্র পরিবারে প্রাথমিক শিক্ষার সামান্য ব্যবস্থা হলেও মাত্র ১৬ বছর বয়সে জীবিকার প্রয়োজনে মুচির দোকানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন। এদেশে বর্ণব্যবস্থার নানা জটিলতার কারণে তখন তাঁতির ছেলে জুতো সেলাই করতে গেলে জাত খোয়াবেন। ওদেশে তখন এত বর্ণবৈষম্য ছিলনা। তাই ওই চমৎকার মেধাবী ছেলেটি বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পরিণত হয়েছে। জ্ঞানপিপাসু বলা হয় তাকে। উদ্ভিদবিদ্যার প্রতি অফুরন্ত আকর্ষণ। নতুন নতুন পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, পর্যবেক্ষণে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত। অন্যদিকে ভাষা পাগল। নতুন নতুন ভাষার দশ দিগন্ত উন্মোচনে ওস্তাদ। মাতৃভাষা ইংরেজি ছাড়াও প্রায় একক চেষ্টায় শিখে ফেলেন লাতিন। একে একে হিব্রু, ইতালি, ফরাসি ভাষা আয়ত্ত করে ফেলেন। এই মানুষটি এদেশে এসে বাংলা, উড়িয়া, মারাঠি, সংস্কৃত, হিন্দি, পাঞ্জাবি প্রভৃতি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
মেদিনীপুরে বন্ধুর সুপারিশে নীলকুঠির ম্যানেজার হয়ে গেলেন। অথচ মানুষকে নীলচাষে কীভাবে উৎসাহিত করেছিলেন তার কোনো নজির ইতিহাসে নেই বরং অশিক্ষার হাহাকারে স্থির থাকতে না পেরে অবৈতনিক দৈনিক পাঠশালা চালু করেন। মেদিনীপুরে চালু করেন স্কুল। রামপাল দীঘিতে একটি কলেজ স্থাপনের চিন্তা নিয়ে উদ্যোগী হন, সফল হননি।
১৭৯৮ তে শ্রীরামপুরে ছাত্রাবাস চালু করেন। ধর্ম প্রচার ও শিক্ষা প্রচারকে তিনি একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাই সদ্য গঠিত ব্যাপ্টিস্ট মিশনের হাতিয়ার হিসেবে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রেস থেকেই ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় বাইবেলের নতুন নিয়ম প্রকাশিত হয়। ওয়েলেসলি গভর্নর জেনারেল আসার পর কোম্পানির নবাগত তরুণ সিভিলিয়ানদের জন্য দেশীয় ভাষা, ভূগোল, ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চার লক্ষ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি সেখানে বাংলা ভাষা শিক্ষার দায়িত্বে শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন ফ্যাকাল্টির প্রধান। এখানেই দেশীয় পণ্ডিতদের সহযোগিতায় শ্রেণীভিত্তিক পাঠ্যপুস্তক রচনার পরিকল্পনা গ্রহণ ও রূপায়ণ শুরু হয়। রামরাম বসু এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রথম দু বছরে তিনটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। বাংলা ব্যাকরণ রচনার দায়িত্ব নেন কেরি নিজেই।
১৮১৪ সালে এদেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাত্পদ মানুষের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে উইলিয়াম কেরি কোম্পানির মাধ্যমে সরকারের কাছে একটি বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব পেশ করেন। যে দলিলটির নাম — Plan for instructing native inhavitants of India in European Science. সারাদেশের বিভিন্ন অগ্রসরমান আঞ্চলিক ভাষার বিকাশে মনোনিবেশ করেন তিনি। সেই সব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক সমস্যা নিরসনে নিজে নিরন্তর অনুবাদের কাজ করেছেন। ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানান কর্মসূচি নিয়েছেন। ১৮১৭ সালে গ্রন্থক্ষুধা নিরসনে কলকাতা স্কুলবুক সোসাইটি স্থাপিত হয়। নেতৃত্বে ছিলেন কেরি সাহেব। দিকদর্শন, সমাচার দর্পণ, Friends of India প্রভৃতি পত্রিকা চালু হয়। স্থাপিত হয় বিখ্যাত শ্রীরামপুর কলেজ। ভারতে স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে মনোনিবেশ করেন তিনি। এমনকি ১৮১৯ সালে বড়লাট পত্নী লেডি হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি কৃষি সমিতি স্থাপন করেন। এই সমিতি বিভিন্ন এলাকায় আদর্শ কৃষি উদ্যান গড়ে তোলে। স্থাপিত হয় হর্টিকালচার সোসাইটি।
তাঁর বর্ণময় জীবনী এবং বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডের কোনও সুবিন্যস্ত ইতিহাস রচনা এই নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। বরং দু একটি গ্রন্থ ছাড়া এখনো উইলিয়াম কেরি নিয়ে সেভাবে কোনো বৃহত্তর উদ্যোগ বাংলায় গৃহীত হয়নি। সেই আক্ষেপ প্রকাশই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
তিনি সতীদাহ প্রথা রদের বিরুদ্ধে ছিলেন, এ তথ্য আমরা জানি (পূর্বে উল্লেখিত)। কিন্তু আমরা রামমোহনের অবদান নিয়ে আলোচনা করতে করতে ভুলে যাই এ প্রসঙ্গে কেরির উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা। ১৮২৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন জারি করেন। এই দিনই সেই আইনের কপি বিশেষ দূতের মাধ্যমে পৌঁছে যায় ডঃ উইলিয়াম কেরির বাড়িতে । সারাদিন ধরে তার বঙ্গানুবাদ করেন কেরি। ঘোড়া ছুটিয়ে তা নিয়ে বেন্টিঙ্ক এর হাতে দিয়ে আসেন।সেদিন থেকেই এই আইনের পক্ষে গ্রামে গ্রামে জনমত তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর প্রয়াণের পর শ্রীরামপুরে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের সমাধি ক্ষেত্রে তাঁকে সমাহিত করা হয়।