জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল চিন্ময় দাশলক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, চক বাজিত (ডেবরা)
সম্রাট আকবরের রাজস্ব সচিব ছিলেন রাজা টোডর মল্ল। তিনি ভূমি-রাজস্ব সংস্কারের জন্য, বাংলা সুবাকে ১৯টি সরকার এবং ৬৮২টি মহাল(পরবর্তীকালের পরগণা)-এ ভাগ করেছিলেন। তখন বর্তমান মেদিনীপুর জেলার মাত্র ৪টি মহাল– চেতুয়া, মহিষাদল, হাভেলি মান্দারণ এবং সাহাপুর– সরকার মান্দারণের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইং ১৬৫৮ সালে, সুলতান সুজার পুণর্বিন্যাসের সময়, সাহাপুর পরগণাটি কিসমৎ মালঝিটার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৬০ সালে, বাংলার নবাব মীর কাশিম এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চুক্তি অনুসারে, মেদিনীপুর জেলা কোম্পানির হাতে যায়। তখন চাকলা (সরকার) মেদিনীপুর যে ৫৪টি পরগনা নিয়ে গঠিত ছিল, তাতে সাহাপুর ছিল তৃতীয়। পরে পরে, কোম্পানির হাতে পরগণাগুলির পুনর্বিন্যাস হয়ে সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১১৫টি। ১৮৭২ – ১৮৭৮ সালের রেভিনিউ সার্ভের রিপোর্ট অনুসারে সাহাপুর পরগণার ভৌমিক আয়তন ৫৭.৫০ বর্গ মাইল। দেশ স্বাধীন হলে, সাহাপুর পরগণাটি ডেবরা থানার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এহেন সাহাপুর পরগনার একটি মাঝারি মাপের গ্রাম চক বাজিত। ” দে ” পদবীর দু’টি জমিদার পরিবারের বাস ছিল এই গ্রামে। দুটি পরিবারই অতীতকাল থেকে শৈব-মতে দেবারাধনা করতেন। এমনকি তিন-তিনটি শিব মন্দিরও নির্মিত হয়েছিল পরিবার দুটির হাতে। নিজের নিজের বসতবাড়ির সামনেই স্থাপিত হয়েছিল মন্দিরগুলি। প্রতিষ্ঠালিপি থেকে দুটি মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার নামও জানা যায়। একটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক রাধামোহন দে। অন্য বংশের জমিদার জনৈক প্রাণকৃষ্ণ দে ছিলেন আর একটি মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা।
তবে, এই দুই জমিদারই নিজের নিজের পরিবারে নতুন করে ভগবান বিষ্ণুর আরাধনার প্রচলন করেছিলেন। প্রকৃত পক্ষে, চৈতন্যদেব প্রবর্তিত প্রেমধর্মের প্রভাবে, সেসময়ে মেদিনীপুর জেলায় এমন কোনও জমিদার কিংবা রাজ পরিবার ছিল না, যাঁরা শৈব আরাধনার পাশাপাশি, নতুন করে বৈষ্ণবীয় রীতিতে ধর্মাচরণের সূচনা করেনি। কিংবা নতুন করে মন্দির নির্মাণ করে, বিষ্ণুশিলা কিংবা রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা এবং পূজার প্রচলন করেনি। চক বাজিতের দুই জমিদারও সেই পথের পথিক হয়েছিলেন।
বিগ্রহের আরাধনা প্রচলিত ছিল পূর্বকালে থেকে। ইং ১৮৯৮ সালে, জমিদার রাধামোহন দে একেবারে তাঁর অট্টালিকার ভিতরেই তাঁদের বিগ্রহ “শ্রীধরজীউ”র জন্য একটি পাকার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এর ১০ বছর পর, ১৯০৮ সালে অন্য জমিদার প্রাণকৃষ্ণ দে তাঁদের পূজিত “লক্ষ্মীনারায়ণজীউ”র জন্য দালান রীতির একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেই মন্দির নিয়েই আমাদের আজকের প্রতিবেদন।
২১ ফুট দৈর্ঘ্য আর সওয়া ১৮ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট পাদপীঠের উপর দালান রীতির পূর্বমুখী মন্দির। পাদপীঠের উচ্চতা ফুট তিনেক। ইটের তৈরী মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ১৭ ফুট, প্রস্থ পৌণে ১৬ ফুট এবং উচ্চতা ১৫ ফুট। দুটি অংশ এই মন্দিরের– সামনে একটি অলিন্দ, আর পিছনে গর্ভগৃহ। অলিন্দের সামনে ৩টি এবং উত্তর ও দক্ষিণে ২টি– মোট ৫টি দ্বারপথ। গর্ভগৃহে ১টিই দ্বার। ৬টি দ্বারই খিলান-রীতির। কলাগেছ্যা-রীতির গুচ্ছ থামের সাহায্যে দ্বারগুলি রচিত হয়েছে।
সৌধটির মাথায় কড়ি-বরগার সমতল ছাউনি। ফলে, কার্নিশগুলি সরলরৈখিক। পূর্বদিকে অর্থাৎ সামনের কার্নিশের মাথায়, আলসের উপরে, সম মাপের ৫টি অনুচ্চ স্তম্ভ নির্মাণ করা। কেন্দ্রীয় স্তম্ভে বেঁকি, আমলক, কলস এবং বিষ্ণুচক্র স্থাপিত। এটির দু’পাশে উপবিষ্ট ভঙ্গিমার ব্যাদিত-বদন দুটি সিংহমূর্তি রচিত হয়েছে।
কার্নিশের নিচ বরাবর টানা একটি প্রতিষ্ঠা-ফলক আছে মন্দিরে। কালো রঙের পঙ্খের প্রলেপের উপর সুন্দর হস্তাক্ষরে খোদাই করে লেখা। বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণ দেখা যায় বয়ানে : ” শ্রীশ্রীলক্ষ্মীজনার্দন জীউর / মন্দির সমাপন হইল শকাব্দ ১৮৩০ সন ১৩১৫ সালের আ / ষাড়স্য অষ্টবিংশতি দিবসে অসীতপক্ষে অষ্টবাসরে সমাপ্ত / হইল মিস্ত্রী শ্রী শশীভূষণ শীল সাং দাসপুর পঃ চেতুয়া। ” অর্থাৎ ১৮৩০ শকাব্দ, ১৩১৫ বঙ্গাব্দ বা ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।
দেবতার রাস-উৎসবের জন্য, একটি রাসমঞ্চও নির্মাণ করেছিলেন প্রাণকৃষ্ণ। সেটি নির্মিত হয়েছিল মন্দির নির্মাণের পরের বছর, অর্থাৎ ১৯০৯ সালে। ফুট তিনেক উঁচু পাদপীঠের উপর হুবহু একটি পঞ্চ-রত্ন মন্দিরের আদলে নির্মিত। প্রচলিত গোলাকার রীতির নয়, ৯ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও ১৮ ফুট উচ্চতার সম্পূর্ণ বর্গাকার সৌধ। মাথায় চালা-রীতির গড়ানো ছাউনি। ৫টি রত্নই কলিঙ্গ-ধারায় প্রভাবিত শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত। কেন্দ্রীয় রত্নে পঞ্চ-রথ এবং বাকি ৪টিতে ত্রি-রথ বিভাজন দেখা যায়।
একই রীতির একটি প্রতিষ্ঠা-ফলক আছে রাসমঞ্চটিতেও– ” শ্রীশ্রীলক্ষ্মীজনার্দনজীউর রাসমন্ডপ। — সকাব্দ সন ১৮৩১ বাংলা সন ১৩১৬ সাল জ্যেষ্টস্যাসিতে পক্ষে /– চত্যারিংস দিনং শশী সমাপ্ত হইল দাসপুর নিবাসী শ্রী শিবনারান চন্দ্র মিস্ত্রী ” ।
অলংকরণের কথায় প্রথম আসে পঙ্খের কাজের কথা। মূলমন্দিরের সামনের দেওয়াল জুড়ে জ্যামিতিক নকশায় পঙ্খের কাজ করা। স্টাকো এবং টেরাকোটা ফলক আছে দুটি সৌধেই।মূল মন্দিরের সামনের দেওয়ালে– সখিদল সহ রাধাকৃষ্ণ, হরিবোল খোদিত দুই গোস্বামী, শিকার-দৃশ্য, পায়রার ঝাঁক ইত্যাদি মোটিফের কাজ। রাসমঞ্চে বিষ্ণুর কয়েকটি অবতার, বলিরাজ দমন, অশ্বারূঢ় সৈনিক ইত্যাদি।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী প্রকৃতি কুমার দে, প্রণয় কুমার দে– চক বাজিত।
পথ-নির্দেশ : ৬ নং জাতীয় সড়ক মুম্বাই রোডের উপর, ডেবরা এবং পাঁশকুড়ার মাঝে, নতুন বাজার স্টপেজ। সেখান থেকে উত্তর মুখে ৩ কিমি দূরে চক বাজিত গ্রাম। নিয়মিত টোটো চলাচল করে এই পথে। এখানে পৌঁছলে, ভগ্ন শিবমন্দির এবং শ্রীধরজীউ মন্দিরটিও দেখে নেওয়া যায়।