জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল
চিন্ময় দাশ কামেশ্বর শিব মন্দির, তল কোঁয়াই (কেশপুর থানা, মেদিনীপুর)
১৬৬০ সালে ওলন্দাজ পরিব্রাজক ফান ডেন ব্রুক একটি মানচিত্র এঁকেছিলেন। তাতে বাংলা এবং ওডিশার সীমানা এলাকায় একটি মন্দিরের ‘আলামত’ (জরীপ বিভাগের পরিভাষা, যার অর্থ– চিহ্ন।) দেখা যায়। ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থেও বলা হয়েছে– সেকালে বাংলার সীমা ছিল সরকার মান্দারণের অন্তর্ভুক্ত চন্দ্রকোণা পরগণার দক্ষিণে অবস্থিত কুবাই বা কোঁয়াই নদী পর্যন্ত। আর, ওডিশার সীমানা ছিল সরকার জলেশ্বরের অন্তর্ভুক্ত ব্রাহ্মণভূম পরগণার উত্তর সীমার কুবাই নদী পর্যন্ত। অর্থ দাঁড়াচ্ছে– এক সময় কুবাই ছিল বাংলা এবং ওডিশার সীমারেখা। ব্রুক সাহেবের মানচিত্রের সেই আলামত ছিল দুই রাজ্যের সীমানায় কুবাই নদীর তীরে অবস্থিত একটি মন্দির। সেই মন্দির নিয়েই আমাদের আজকের জার্নাল।
এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রতিষ্ঠাতার কথা জানতে হলে, পুরো পৌনে বারোশ’ বছর পিছনের দিকে তাকাতে হবে আমাদের। অতি সংক্ষেপে সেই পুরাতনী কথা পাঠক-পাঠিকাদের অবগত করব আমরা।
জানা যায়, ইং ৮৫০ সালে জনৈক উমাপতি ভট্টাচার্য্য গঙ্গাতীরবর্তী ঋষিঘাটা থেকে মেদিনীপুর জেলায় চলে এসেছিলেন। পরে, চন্দ্রকোণার রাজার কুলগুরু হয়েছিল এই মহাপন্ডিত বংশ। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, অর্থাৎ হিন্দু রাজত্বের শেষ পর্বে, এই জেলার জঙ্গল-মহল এলাকায় বহু ছোট ছোট অনার্য রাজাদের শাসন ছিল। চন্দ্রকোণার রাজা ভঞ্জভূম পরগণার তোড়িয়ার তেমনই এক মাঝি-রাজাকে পরাজিত করে, সেই রাজ্য তাঁদের গুরুদেব ত্রিলোচন ভট্টকে প্রণামী দিয়েছিলেন।
ত্রিলোচন ভট্ট নিজের জমিদারি প্রতিষ্ঠা করে, আঢ়রাগড়ে রাজধানী স্থাপন করেন। পরে, সেই পরিবারের অধিকৃত এলাকা ব্রাহ্মণভূম পরগণা নামে পরিচিত হয়েছিল।
এই সীমিত নিবন্ধে বিশাল এই বংশের কুলাখ্যান-পত্রের বিবরণ দেওয়ার অবকাশ নাই। কেবল ২টি বিষয় উল্লেখ করা যায়– ১. ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পর্বে এই বংশে রাজা ছিলেন বাঁকুড়া রায় এবং তাঁর পুত্র রঘুনাথ রায়। কাজীর অত্যাচারে ভিটেছাড়া হয়ে কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বর্ধমানের দামিন্যা গ্রাম থেকে পালিয়ে, এই বাঁকুড়া রায়ের কাছে এসে আশ্রয় পেয়েছিলেন। সভাকবি এবং বালক রঘুনাথ রায়ের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন মুকুন্দরাম।
পরে, রঘুনাথের রাজত্বকালে, চন্ডীমঙ্গল রচনা করেন মুকুন্দরাম। তিন রাত্রি বা বারো প্রহর কাব্য পাঠ শেষ হলে, নিজের হাতের সুবর্ণ-কঙ্কন গুরুদেব-কবির হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন রঘুনাথ। তখন থেকে বাংলার যুগন্ধর এই কবি “কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম” নামেই পরিচিত হয়ে আছেন।
পরম ধার্মিক রঘুনাথ বর্ধমান রাজার কাছ থেকে ‘দেব’ উপাধি পেয়েছিলেন। সেই থেকে তাঁর বংশ দেব উপাধিকেই পদবী হিসাবে ব্যবহার করে আসছেন।
২. রঘুনাথের পুত্র উমাপতি দেবের সময়ে বর্গীর অত্যাচার শুরু হয়। অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে উমাপতির পৌত্র ত্রিলোচন দেব আঢ়রাগড় ছেড়ে, ডেবরার ত্রিলোচনপুরে উঠে এসেছিলেন। কিন্তু ইংরেজের সাথে বিবাদের কারণে, ত্রিলোচনপুর ছেড়ে কেশপুর থানার গড়সেনাপত্যা গ্রামে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে সেই গ্রামে বনেদি দেব বংশের ৫০-৬০টি শরিক পরিবার বসবাস করে আছেন।
যাইহোক, আমরা মন্দিরের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। লোকশ্রুতি আছে, এক গৃহস্থের গাভী নিয়মিত জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে একটি পাথরের মাথায় দুধ ঝরিয়ে আসত। গ্রামের মানুষজন সেই পাথরকে শিব জ্ঞানে পূজা শুরু করেছিলেন। ভট্টবংশের প্রথম রাজা উমাপতি ভট্ট মহাদেবের স্বপ্নাদেশ পেয়ে, সেখানে দেবতাকে স্বস্থানে রেখেই, মন্দিরটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।
দেবতার সেবাপূজার ব্যয়নির্বাহের জন্য, সম্পত্তিও দান করেছিলেন উমাপতি। কেবল তাই নয়, বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্র বাহাদুরও ৩০০ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তির সনন্দ দিয়েছিলেন মহাদেবকে।
এখানে দেবতার নাম — কামেশ্বর। নামের তাৎপর্য পাওয়া যাবে পুরাণ কাহিনীতে। অষ্টসখী সহ রাধারাণীর সাথে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা দেখে, একবার দেবী পার্বতীও জয়া-বিজয়া প্রমুখ সখীদের নিয়ে মহাদেবের সাথে অনুরূপ রাসক্রীড়ায় আগ্রহী হয়েছিলেন। কিন্তু শঙ্কর সম্মত না হওয়ায়, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নারদ ঋষির মাধ্যমে দেবী পার্বতীকে অনুমতি দিয়েছিলেন। তাতে আহ্লাদিত পার্বতী সখীদের নিয়ে অষ্টভৈরবী মূর্তি ধারণ করলে, মহাদেবও অষ্টভৈরব মূর্তি ধারণ করে, কামিনীগণের সাথে রাসলীলায় মেতেছিলেন। তখন থেকে মহাদেবের এক নাম হয়েছে– কামেশ্বর শিব।
যাইহোক, মন্দির নির্মাণের পর, পুনরায় মহাদেবের স্বপ্নাদেশ পেয়ে, পুরীর তুলসিচোরা গ্রাম থেকে জগমোহন পণ্ডা এবং বীররামচন্দ্রপুর গ্রাম থেকে হরিহর ত্রিপাঠি নামক দুই নিষ্ঠাবান উৎকল ব্রাহ্মণকে পুরোহিত হিসাবে এনেছিলেন উমাপতি। সেই দুটি বংশই এখনো এখানে মন্দিরে যুক্ত আছে।
মাঘ-ফাল্গুনের শিবরাত্রি, চৈত্রের সংক্রান্তি উপলক্ষে গাজন এবং শ্রাবণ মাসে বরুণ-যজ্ঞ– এই মন্দিরের বিশেষ উল্লেখযোগ্য উৎসব। হাজার- হাজার মানুষের সমাগম ঘটে উৎসবগুলিতে।
মাকড়া পাথরে নির্মিত পূর্বমুখী মন্দির। সামনে জগমোহন, পিছনে বিমান বা মূল মন্দির এবং মাঝখানে একটি অন্তরাল– এই নিয়ে শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত হয়েছে। জগমোহন সৌধটি একটু স্থুলকায়– দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ২০ ফুট, উচ্চতা ৪০ ফুট। বিমানের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সাড়ে ১৫ ফুট, উচ্চতা আনু. ৫০ ফুট। মাঝখানে ৪ ফুট পরিসরের অন্তরাল।
কলিঙ্গ স্থাপত্য-ধারার দুটি বৈশিষ্ট দেখা যায় এই মন্দিরে– ১. বিমান এবং জগমোহন উভয় সৌধেই বাঢ় ও গন্ডী অংশ জুড়ে ‘সপ্ত-রথ’ বিভাজন করা হয়েছে। ২. ‘পীঢ়-রীতি’ প্রয়োগ করা হয়েছে জগমোহনের গন্ডী অংশটিতে। সেটি ভূমির সমান্তরালে তিনটি প্রশস্ত ‘থাক’-এ ভাগ করা।
জগমোহন, অন্তরাল এবং বিমান– তিনটি সৌধেরই ভিতরের ছাদ বা সিলিং নির্মিত হয়েছে চতুস্কোণ লহরা পদ্ধতিতে।
জগমোহনের মূল প্রবেশদ্বারের দু’পাশে দুটি দ্বারী-মূর্তি এবং কৃষ্ণ-বলরাম মূর্তি দেখা যায়। এগুলি স্টাকো-র কাজ। বিমান সৌধের উত্তর ও দক্ষিণের দেওয়ালে গন্ডী অংশে, কলিঙ্গ-রীতির অনুসরণে, পাথরে খোদিত দুটি ‘ঝাপ্পা-সিংহ’ মূর্তি স্থাপিত আছে। এগুলি ছাড়া, অন্য কোনও অলংকরণ মন্দিরে নাই।
বিশেষভাবে বলতে হয় মন্দিরের শীর্ষক বা চূড়াটির কথা। এই মন্দিরের অন্য একটি নাম– “নেড়া দেউল”। এমন নাম হওয়ার দুটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়– ১. কিংবদন্তিতে বলা হয়, মন্দিরের চূড়া তৈরী হওয়ার আগেই সকাল হয়ে যাওয়ায়, বিশ্বকর্মা চলে গিয়েছিলেন। তা থেকেই দেউলটি ‘নেড়া’ নামে আখ্যাত হয়েছিল। ২. ঐতিহাসিকেরা বলেন– রাঢ় দেশের প্রান্তসীমার এই মন্দিরের নাম ছিল– ‘রাঢ়া দেউল’। লোকমুখে অপভ্ৰংশে সেটিই ‘নেড়া দেউল’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
যাইহোক, দীর্ঘকাল বড় আকারের একটি আমলক মন্দিরের সামনে পড়ে থাকতে দেখা যেত। পরবর্তীকালে সংস্কার কাজের সময়, মন্দিরের চূড়ায় আমলক ইত্যাদি যোগ করা হয়েছে।
সাক্ষাৎকার : (২০০৮ সালে) প্রয়াত পবন চন্দ্র ঘোষ– তল কোঁয়াই। প্রয়াত রামকৃষ্ণ দেব– অলিগঞ্জ, মেদিনীপুর শহর।
(২০১৭ সালে) সর্বশ্রী স্বরাজ রঞ্জন পণ্ডা, অসিত কুমার ত্রিপাঠী, বিমল সার– তল কোঁয়াই (নেড়াদেউল)।
পথ-নির্দেশ : মেদিনীপুর থেকে চন্দ্রকোণা মুখী যে কোনও গাড়িতে নেড়াদেউল স্টপেজ। চন্দ্রকোণা রোড, ঘাটাল কিংবা আরামবাগের দিক থেকে এলে, চন্দ্রকোণা পৌঁছে কেশপুর মুখী পথে নেড়াদেউল। বাসরাস্তার পাশেই মন্দিরটি অবস্থিত।