জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৯২ চিন্ময় দাশমহারুদ্র সিদ্ধনাথ শিব মন্দির, রেয়েপাড়া (নন্দীগ্রাম)
বহুল প্রচারিত এক কিংবদন্তি জড়িয়ে আছে এ মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সাথে। বহু প্রাচীন কালের কথা। তখন হিজলী বা খেজুরি বন্দরের মত, রেয়েপাড়াও ছিল সমুদ্র লাগোয়া স্থলভাগ। ঝোপজঙ্গলে ঢাকা। একবার চন্দন বণিক নামের এক সওদাগর সমুদ্রপথে যাওয়ার সময়, মিষ্টিজলের জন্য এখানে নেমেছিলেন। একটি কূপের খোঁজ পেয়ে, জল তোলার জন্য, পেতলের পাত্র ডোবালে, সেটি সোনা হয়ে গিয়েছিল।
সেদিন রাতেই শিবের স্বপ্নাদেশ পান সওদাগর। কূপের কাছে সাত ঘোড়া মোহর পান তিনি। পরম আহ্লাদিত হয়ে, কুপটিকে দেওয়াল দিয়ে ঘিরে, মহাদেবের জন্য মন্দির বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেবতার নির্দেশ অমান্য করে, নির্মাণকাজ শেষ হবার আগে, মন্দির দেখার আগ্রহে পিছন ফিরে তাকিয়েছিলেন সওদাগর। তাতেই বিপত্তি। মন্দিরের চূড়ার কাজ অসমাপ্ত রেখে, দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা ফিরে চলে যান। মোহর সহ নৌকাডুবি হয়ে, সলিল সমাধি হয়ে যায় বণিকের।
একেবারে গল্পকথার মতোই এ কাহিনী। কিন্তু এর শেষ পর্বটির সাথে বাস্তবের কিছু যোগ পাওয়া যায়। যেমন– ১. মন্দিরের ইট তৈরির জন্য, সিন্ধুরায় নামের এক দেবতাকে নাকি নিয়োগ করা হয়েছিল। আজও রেয়েপাড়ায় ‘সিন্ধরিয়া তলা’ নামের একটি স্থান এবং সেখানে ‘সিন্ধুরায়’ নামিত ঠাকুরের পূজার প্রচলন আছে। ২. স্বামী ঘরে না ফেরায়, অনেক বছর অপেক্ষার পর, খোঁজ করতে করতে সওদাগরের পত্নী সৌদামিনী এই মন্দিরে এসেছিলেন। স্বামীর নৌকা উদ্ধারের আশায় যে জায়গাটি খুঁড়েছিলেন তিনি, সেই দীঘি আজও ‘রানীসা’ (রানীর সাগর) নামে পরিচিত। ৩. পানীয় জলের জন্য, দাসী মল্লিকাকে দিয়ে নতুন একটি দীঘি কাটিয়েছিলেন সৌদামিনী। সেটিও বহাল আছে, নাম– ‘মল্লিকাদীঘি’।
কিংবদন্তি ছেড়ে আমরা এবার গ্রামটির নামের দিকে তাকাই– রেয়েপাড়া। এই নাম দুটি শব্দের সমাহার– রেয়ে এবং পাড়া। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে ‘রেয়ো’ শব্দের অর্থ বলা হয়েছে– রবাহূত। পূর্বকালে অবিভক্ত বাংলার কুষ্ঠিয়া, ময়মনসিংহ, ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, শ্রীহট্ট এবং ত্রিপুরা ও আসামের কাছাড় অঞ্চলে এক শ্রেণীর কবি ও গায়কের বাস ছিল। ‘রেয়ো ভাট’ নামে পরিচিত ছিলেন তাঁরা। সম্পন্ন পরিবারের অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ, শ্ৰাদ্ধ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে আচম্বিতে উপস্থিত হয়ে, গৃহকর্তা বা তাঁর পরিবারের বর্ণনা করে, গান গাইতে শুরু করে দিতেন তাঁরা। পাছে মন্দ বা নিন্দাসূচক কিছু গেয়ে না বসে, তটস্থ হয়ে ভালো মতন পারিতোষিক দিয়ে বিদায় করা হত তাঁদের। হুগলি জেলার ভাটপাড়া, হাওড়ার ভোটবাগান ইত্যাদি এঁদেরই বসতি থেকে নাম পেয়েছে। মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রাম থানার এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে এই রেয়ো গোষ্ঠীর মানুষেরা এসে বসবাস গড়েছিলেন। তা থেকেই নাম হয়েছে– রেয়েপাড়া (রেয়ো > রেয়ে)।
এই মন্দিরের পরিচালক বা সেবাইতদের সম্পর্কে বলা হয়– অতীতে কাশীধামের বিশ্বেশ্বর, তারকেশ্বরের তারকনাথ এবং রেয়েপাড়ার এই সিদ্ধনাথ– তিন দেবতা ও মন্দির একটিই পরিচালন ব্যবস্থার অন্তর্গত ছিল। পরবর্তীকালে এই মন্দির তারকেশ্বর মহামন্ডল-এর অন্তর্গত ‘ দশনামী সম্প্রদায়’-এর পরিচালনায় আসে।
এই অবকাশে ‘দশনামী’ প্রসঙ্গে দু-চার কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। দশনামী হল কয়েকজন সাধকের সম্মিলনী। ‘অদ্বৈতবাদ’-এর প্রচারক শঙ্করাচার্যের ৪ জন শিষ্য ছিলেন– পদ্মপাদ, হস্তামলক, মন্ডন এবং ভোটক। এঁদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব শিষ্য ছিল। পদ্মপাদ-এর ২ শিষ্য– তীর্থ ও আশ্রম। হস্তামলক-এর ২ শিষ্য– বন ও অরণ্য। মন্ডন-এর ৩ শিষ্য– গিরি, পর্বত ও সাগর। এবং ভোটক-এর ৩ শিষ্য– সরস্বতী, ভারতী ও পুরী। শঙ্করাচার্য্যের এই ১০ জন প্রশিষ্য থেকে ‘দশনামী সম্প্রদায়’-এর উদ্ভব।
প্রত্যেক দশনামী ‘মোহান্ত’ হিসাবে কোন না কোনও মঠের সাথে যুক্ত থাকতেন। সাধারণভাবে দশনামীগণ নির্গুণ উপাসক হলেও, তাঁদের অনেকেই প্রথমে শিব-মন্ত্র গ্রহণ এবং শিব-স্তোত্র পাঠ করে থাকেন।
ভোটক-এর ৩ শিষ্য– সরস্বতী, ভারতী ও পুরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন শৃঙ্গগিরি মঠে। সেই মঠের ভারতী-র উত্তরাধিকারীগণ রেয়েপাড়ার এই মন্দিরের পরিচালনার ভার নিয়ে এসেছিলেন। বর্তমানে রেয়েপাড়ার স্থানীয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের নিয়ে পরিচালন কমিটি গঠিত আছে। তবে ভারতী সম্প্রদায়ের পরিচালনার শেষ পর্বে রামনারায়ণ ভারতী, অক্ষয় কুমার ভারতী এবং প্রসন্ন কুমার ভারতী গোস্বামী এখানে যুক্ত ছিলেন।
বিশাল এক প্রাঙ্গণের ভিতর মন্দিরটি অবস্থিত। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। নিত্যদিন বহুসংখ্যক যাত্রীর সমাগম এই মন্দিরে। মানতের পূজাতেই কেটে যায় সারা দিনমান। বছরের দুটি উৎসব শিবরাত্রি আর গাজনে বিপুল আড়ম্বর। ১৬ ভোগের গাজনে মেলা বসে ১৫ দিনের জন্য। জেলার অন্যতম বড় গাজন মেলা এই মন্দিরে।।
তবে, মন্দিরটির আয়ুষ্কাল নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যায় না। কোনও প্রতিষ্ঠালিপি নাই মন্দিরে। পূর্বকালের একটি কিংবদন্তির কথা বলেছি আমরা। সেটি ছাড়া, নাই অন্য কোনও নথিপত্রও। তবে পুরাবিদরা কিছু অনুমান করেছেন, সৌধটির স্থাপত্য বিচার করে। যেমন, তারাপদ সাঁতরা বলেছেন– ” প্রতিষ্ঠালিপিহীন, এ মন্দিরটি আকারপ্রকারে, সতের শতকের শেষ দিকে নির্মিত বলেই অনুমান। ” আমরাও এর সাথে সহমত পোষণ করি।
শিখর দেউল রীতির এই মন্দির ইটের তৈরী। সম্পূর্ণ বর্গাকার মন্দিরটির দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ ২৩ ফুট হিসাবে। কিন্তু সেই অনুপাতে এর গর্ভগৃহ বেশ অপরিসর। মাত্রই ১১ ফুট দৈর্ঘ্য প্রস্থের। কারণ হল এর দেওয়ালের প্রস্থ ৬ ফুট। বেশ বিস্ময়কর। উল্লেখ করবার মত আর একটি বিষয় হল, মন্দিরটি উত্তরমুখী। মেদিনীপুর জেলায় উত্তরমুখী প্রাচীন মন্দির হাতে গোণা কয়েকটি মাত্র। এটি তার অন্যতম। মন্দিরের আনুমানিক উচ্চতা ৫০ ফুট।
একাধিক বার সংস্কার হয়েছে মন্দিরটির। ফলে, আকারগত কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এই সৌধের। যেমন– ১. পূর্বে সংক্ষিপ্ত আকারের একটি জগমোহন অংশ ছিল সামনে। সেটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ২. প্রশস্ত আকারের উন্মুক্ত একটি নাটমন্দির নির্মিত হয়েছে, যা পুরাকালে ছিল না। ৩. মন্দিরের অসমাপ্ত উপরের অংশটি নির্মাণ করে নেওয়া হয়েছে।
সৌধটির বাঢ়, গন্ডী, এমনকি ভিত্তিবেদী জুড়ে রথ-বিন্যাস করা হয়েছে। এখানে সপ্ত-রথ বিন্যাস। শীর্ষক অংশটি বেশ সুরচিত– বেঁকি-র উপর বিশালাকার আমলক, কলসমালা, ত্রিশূলদন্ড স্থাপিত। বর্তমানের মন্দিরে কোনও অলঙ্করণ নাই।
প্রশস্ত প্রাঙ্গণের মাঝে মন্দিরটি অবস্থিত। গণেশ এবং কালী– দুই দেব দেবীর পৃথক মন্দিরও আছে একই পরিসরে। সাজিয়ে তুলতে পারলে, বিপুল পর্যটন সম্ভাবনা আছে এই দেবস্থলীর।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী প্রণব কুমার চক্রবর্তী, সমীর চক্রবর্তী (মন্দিরের ২ পুরোহিত) শ্রী রামকৃষ্ণ শী (প্রধান কর্মচারী)– রেয়াপাড়া। অধ্যাপক শ্রী দিলীপ কুমার মান্না, গ্রন্থকার– দেবীপুর।
পথ-:নির্দেশ : হাওড়া-খড়্গপুর রেলপথের মেচেদা স্টেশন থেকে দীঘা গামী রাস্তায় মঠ চন্ডীপুর। সেখান থেকে নন্দীগ্রামমুখী পথের উপরেই রেয়েপাড়া। কলকাতার দিক থেকে যে কোনও দীঘাগামী বাস চন্ডীপুর হয়ে যাতায়াত করে।
জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-৯২; চিন্ময় দাশ
RELATED ARTICLES