জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল চিন্ময় দাশরঘুনাথ মন্দির, বনপাটনা (খড়গপুর থানা, মেদিনীপুর)
আদি নিবাস ছিল তুষারমৌলি হিমালয়ের দেশ কাশ্মীরে। সেখান থেকে ‘ধর’ পদবীর এক কাশ্মীরি পন্ডিত জগন্নাথ দর্শনের জন্য পুরীধামে এসেছিলেন। সেই যে নেমে এসেছিলেন হিমালয়ের দেশ থেকে, পথ চলা শেষ হয়নি তাঁর। এমনকি তাঁর বংশধরদেরও। আজকের জার্নালের কথকতা সেই বংশের পথ-পরিক্রমা নিয়েই।
শৈবভূমির পন্ডিত জগন্নাথক্ষেত্রে পৌঁছে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। পৈতৃক ভূমির মায়া কাটিয়ে নতুন করে ভিটে গড়ে তুলেছিলেন নতুন দেশে। পুরী নগরী থেকে অনতিদূরের এলাকা বিরামপুর শাসন। সেখানে রামচন্দ্রপুর গ্রামে নতুন ভিটেমাটির ব্যবস্থা করে, নতুন বংশের পত্তন করেছিলেন স্থায়ীভাবে। জানা যায়, কিছুকাল বাদে, নিষ্ঠা এবং পান্ডিত্যের গুণে, এই পন্ডিতবংশ পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে পান্ডা হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিল। সেই সুবাদে, ওডিশার সমাজ জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গিয়েছিল পন্ডিতবংশটি।
বংশটি হিমালয় থেকে এসেছিল ‘ধর’ পদবী নিয়ে। কিন্তু এই সমুদ্রের দেশে, এক রোমাঞ্চকর ঘটনায়, পুরাতনের বদলে, এক নতুন পদবীতে পরিচিত হয়ে উঠেছিল বংশটি। একবার বিরামপুর শাসন এলাকার দুই সম্পন্ন পরিবারের মধ্যে বৈষয়িক ব্যাপারে বিবাদের সূত্রপাত হয়। জানা যায়, পুরীরাজের দরবার পর্যন্ত গড়িয়েছিল বিবাদটি। বিচারের একেবারে শেষ পর্বে, ধরবংশের এক ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসাবে হাজিরা দিতে ডাকা হয়েছিল। রায়দান তখন নির্ভর করছে তাঁর বয়ানের উপরই। বিবাদী পক্ষ মামলা জিতবার জন্য মরীয়া। তারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করে সাক্ষীকে। প্রথমে আবেদন-নিবেদন, পরে প্রলোভন, অবশেষে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয় তাঁকে। রাজাও সংগোপনে অবগত হচ্ছিলেন সমস্ত বিষয়টা।
সাক্ষী কিন্তু কোনও কিছুতেই মাথা নত করেননি। ভরা দরবারে সত্য উচ্চারণ করেছিলেন অকুতোভয় চিত্তে। ধন্য ধন্য করে উঠেছিল সভা। আর পুরীরাজ? সাক্ষীর সত্যভাষণে প্রীত হয়ে, “সৎ পথী” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন তাঁকে। তখন থেকে ‘ধর’ পদবি ত্যাগ করে, ‘সৎপথী’ পদবী প্রচলিত হয়েছে বংশটিতে।
মেদিনীপুর জেলা ওডিশার সীমান্ত লাগোয়া। পরবর্তীকালে সৎপথী বংশের এক সদস্য ব্যবসার সুবাদে রামচন্দ্রপুর ছেড়ে মেদিনীপুরে চলে এসেছিলেন। বলরামপুর পরগণার পরাণনগর গ্রামে স্থায়ী বসবাস শুরু করেছিলেন তিনি। বলা হয়, প্রথম যিনি এসেছিলেন, তাঁর নাম– চৈতন্য চরণ সৎপথী। তাঁর এক উত্তর পুরুষ ছিলেন রামচন্দ্র। রামচন্দ্রের দুই পুত্র– জানকীরাম ও বলরাম। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবাদে, বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন দুই সহোদর। জানকীরামের পুত্র নারায়ণ সৎপথীর সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিল বলরামপুরের রাজা নরহর চৌধুরীর সাথে।
একটি মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছিল দুই সুহৃদের মধ্যে। যোগেশচন্দ্র বসু-র ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ ছাড়াও, বহু গ্রন্থ বা সরকারী রিপোর্টেও, এর বিবরণ পাওয়া যায়।
এক বছর ‘সূর্যাস্ত আইন’-এর আওতায়, রাজ সরকারে খাজনা জমা করবার প্রয়োজনে, নারায়ণের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন নরহর চৌধুরী। কিন্তু মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও টাকা শোধ না দেওয়ায়, তাগাদা পাঠিয়েছিলেন নারায়ণ। এক ভয়ানক ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল তাতেই। ঋণ শোধ না করে, নারায়ণকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করেছিলেন রাজা। অগত্যা অর্থের আশা ত্যাগ করে, প্রাণটুকু রক্ষার তাগিদ বড় হয়েছিল সেই বিপদের মুখে। নৃশংস নরহরের রাজ্যসীমা ছেড়ে, চিরকালের জন্য পালিয়ে আসতে হয়েছিল নারায়ণকে।
সেসময় পার্শ্ববর্তী নারায়ণগড়ের রাজা ছিলেন পরীক্ষিত পাল। তাঁর আশ্রয় নিয়ে, কিসমত নারায়ণগড় পরগণার বল্লার খাল পার হয়ে, বনপাটনা গ্রামে এসে স্থায়ী বসত গড়েছিলেন। এখানেও কাপড়ের ব্যবসাই ছিল নারায়ণের জীবিকা।
সেই ব্যবসার অর্থে, নতুন করে বড় আকারের একটি জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিল এই বংশ। মহাল ছিল দিগপারুই, তপ্পে কেশিয়াড়ি, কিসমত নারায়ণগড় ইত্যাদি পরগণায়। ১৮০১ সালে মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ. স্ট্রেচি সাহেব, ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলিকে, জেলার ১৮ জন সম্ভ্রান্ত এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তির নামের একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন। তালিকার তৃতীয় নামটি ছিল বনপাটনার জমিদার লক্ষ্মীশ্বর (মতান্তরে, লক্ষ্মীচরণ) সৎপথীর।
জমিদারি পরিচালনায় দক্ষতার কারণে, ‘চৌধুরী’ খেতাব পেয়েছিল এই বংশ। এই বংশে একজন খ্যাতনামা জমিদার ছিলেন চৌধুরী গজেন্দ্র নারায়ণ। ১৯১৭ সালে তাঁকে ” রায় বাহাদুর ” খেতাবে ভূষিত করেছিল ইংরেজ সরকার। এমন মান্যতা ছিল মানুষটির, রায় বাহাদুর-এর পালকি না পৌঁছলে, রেল কোম্পানির ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকতো বেনাপুর স্টেশনে।
জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে, অট্টালিকা, কাছারিবাড়ি, আস্তাবল, হাতি-ঘোড়ার জলপানের জন্য ‘হাতিগেড়িয়া’ নামের জলাশয়– কতকিছুই না গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই সাথে গড়া হয়েছিল কয়েকটি দেবালয়ও। চৈতন্যদেবের প্রভাবে বাংলায় তখন গৌড়ীয় প্রেমধর্মের প্লাবন। সেই প্রভাবে গড়া হয়েছিল লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির। তাঁদের আদি পুরুষ এসেছিলেন শৈবভূমি হিমালয় থেকে। শিবমন্দিরও গড়া হয়েছিল একটি।
কিন্তু বর্তমান সৎপথীরা এসেছিলেন শ্রীক্ষেত্র পুরী জগন্নাথধাম থেকে। রায় বাহাদুর গজেন্দ্র নারায়ণের পিতা ব্রজমোহন-এর মনের সাধ ছিল, একটি জগন্নাথ মন্দির স্থাপন করবেন। কিন্তু মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে, জগন্নাথের পরিবর্তে, রঘুনাথ মন্দির নির্মাণের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন তিনি। সেই অনুসারে, পিতা-পুত্র উভয়ের তৎপরতায়, ১৮৬৮ সালে বর্তমান আলোচ্য রঘুনাথ মন্দিরটি গড়ে তোলা হয়েছিল।
পূর্বকালের প্রতিষ্ঠিত বিশালাকার অষ্টধাতুর মূর্তিগুলি আজ আর নাই মন্দিরে। বর্তমানে পূজিত রামচন্দ্র-সীতাদেবী, ভরত, শত্রুঘ্ন, লক্ষ্মণ, সুগ্রীব, অঙ্গদ, হনুমান এবং শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারাণীর সুশোভন মূর্তিগুলি শ্বেতপাথরে নির্মিত। এর সাথে ২৯টি শালগ্রাম শিলাও মন্দিরে পূজিত হন।
নিত্য দু’বার পূজা ছাড়াও, বারো মাসে তেরো পার্বণের আয়োজন হয় মন্দিরে। ১৯৭১ সালে গঠিত “চৌধুরী রমেশ চন্দ্র সৎপথী পাবলিক দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ড” গঠিত হয়েছে। বর্তমানে সভাপতি– শ্রী নয়নারঞ্জন সৎপথী। সম্পাদক– শ্রী প্রণব রঞ্জন সৎপথী। বোর্ডই দেবতার সেবাপূজা পরিচালনা করে থাকে।
দক্ষিণ ভারতের ‘দুর্গ-মন্দির’-এর আদলে গড়া হয়েছে মন্দিরটিকে। ৮/১০ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভেতরের প্রাঙ্গণে রয়েছে মূল মন্দির, বিশাল স্নানবেদী, ইমারতি-রীতির তুলসীমঞ্চ, গরুড়-স্তম্ভ, পাকশালা, গুদামঘর, সারি সারি অতিথিশালা ইত্যাদি। সবকিছু নিয়ে “ঠাকুরবাড়ি” নামে পরিচিত এই দেবস্থলীটি। বনপাটনা গ্রামের সামান্য পূর্বদিকে প্রাচীন কটক রোড অবস্থিত। পূর্বকালে পুরী কিংবা গঙ্গাসাগর অভিযাত্রী সাধু-সন্ন্যাসীর দল এসে আতিথ্য নিতেন এখানে। হাতি বা উটের কাফেলা সাজিয়ে মাঝে মাঝেই অতিথিশালায় এসে উপস্থিত হতেন তাঁরা।
পঞ্চ-রত্ন রীতির পূর্বমুখী বর্গাকার মন্দির, উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ২৫ ফুট, উচ্চতা আনু. ৩৫ ফুট। একটি প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে।
গর্ভগৃহের চার দিক জুড়ে একটি অলিন্দ রচিত হয়েছে। তাতে খিলান-রীতির তিনটি করে দ্বারপথ। পূর্ব এবং উত্তরে দুটি দ্বারপথ আছে গর্ভগৃহে। একটি সিঁড়ি রচিত আছে গর্ভগৃহের ভিতর থেকে।
অলিন্দগুলির সিলিং হয়েছে টানা-খিলান রীতিতে। চার দেওয়ালে চাপা-খিলানের মাথায় বড় গম্বুজ স্থাপন করে, নির্মিত হয়েছে গর্ভগৃহের সিলিং। সবগুলি রত্নেই পঞ্চ-রথ বিন্যাস এবং পীঢ়-রীতি প্রয়োগ করা হয়েছে। শীর্ষক অংশ বেঁকী, আমলক, কলস এবং ধ্বজদন্ড শোভিত। রত্নগুলির মাথায় চালা-ছাউনি হলেও, কার্নিশগুলি সরলরৈখিক।
সামনে অষ্ট-দ্বারী একটি নাটমন্দির আছে এখানে। মাথায় চালা ছাউনি দেওয়া। ভিতরের সিলিং হয়েছে চারটি অর্ধ-খিলান রচনা করে।
অলঙ্করণ হিসাবে দেখা যায়– ১. কার্নিশের নীচ বরাবর এক সারি পারাবত। ২. কেন্দ্রীয় রত্নের সামনের রাহায় দুটি সিংহমূর্তি। ৩. স্নানবেদি এবং নাটমন্দিরে কয়েকটি পূর্ণাবয়ব মনুষ্যমূর্তি।
এছাড়া, মূলমন্দিরের বাইরের দেওয়াল এবং গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে জ্যামিতিক ও ফুলকারী নকশায় উন্নত পঙ্খের কারুকাজ ছিল।
তবে, সৌধগুলির কাঠামো এবং কারুকাজ– সবই বর্তমানে ভারী জীর্ণতার শিকার। অবিলম্বে এটির সংস্কারের কাজে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলকে। সরকারি-অসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি তৎপর হলে, এই ঐতিহাসিক সৌধটিকে এখনও রক্ষা করা যেতে পারে।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী প্রণব রঞ্জন সৎপথী, নয়নারঞ্জন সৎপথী– বনপাটনা।
পথ-নির্দেশ : মেদিনীপুর কিংবা খড়্গপুর থেকে দক্ষিণে, বেলদা গামী পুরাতন রাস্তায় শ্যামলপুর। সেখান থেকে ৩ কিমি পশ্চিমে বনপাটনা গ্রাম।
জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ১০০।। চিন্ময় দাশ
RELATED ARTICLES