বিশেষ সংবাদদাতা: গভীর সমুদ্রে সবে দেখা মিলেছিল ইলিশের, আটশ থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ। দিঘার মোহানা বাজারে সে ইলিশ এখন কেজিতে নয় বিকোচ্ছে ‘পিস’ হিসাবে, আঠার’শ থেকে দু’হাজার টাকা কেজি! লকডাউন আর সমুদ্রে মাছের প্ৰজনন কালীন সময়ের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সবে মাত্র দিন ছয়েক শ’খানেক ট্রলার নিয়ে আর সমুদ্রে নেমেছেন মৎসজীবীরা আর তাঁদের হাতেই দিঘার বাজারে উঠে এসেছে মাত্র ৬০০কেজির কাছাকাছি। মরুভূমিতে বৃষ্টির ফোঁটার মত বাজারে পড়তে না পড়তেই সেই নধরকান্তি পেট চওড়া রক্তিম আভার ইলিশ উবে গেছে বাতাসের মত। ভদ্রলোকের এক কথার মতই, কোনোও দরাদরি না করেই, ওই প্রতি পিস আঠার’শ থেকে দু’হাজারেই।
গত সপ্তাহ থেকে ফের শুরু হওয়া মৎস শিকারে পমফ্রেট, চিংড়ি, রুলি,কাওয়ালিরা ধরা দিলেও আশানুরূপ ভাবে দেখা মেলেনি ইলিশ সুন্দরীদের। আর সেই সুযোগ নিয়েছে দক্ষিন ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারের ব্যবসায়ীরা। হায় ইলিশ, হায় দিঘার ইলিশ বলে হা পিত্যেশ করে বুক চাপড়ানো করোনা ক্লান্ত বাঙালির জন্য দিঘার বাজারে নিয়ে এসেছেন ডায়মন্ড হারবারের মৎস্য ব্যবসায়ীরা। খোলাবাজার ,যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মতই যুক্তবাজারীয় কাঠামোতে হলদিয়ার ইলিশ যেমন কোলাঘাটের ইলিশ বলে চলে যায় ঠিক তেমনই ডায়মন্ড হারবারকে দিঘা বলেই সাঁটিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। খোকা ইলিশের বড়দা সাইজ, চারশ থেকে সাড়ে চারশ ওজনের সেই ইলিশ বলতে লজ্জা লাগা ইলিশ বিকোচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৬০ টাকা কেজিতে। এ যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো!
কিন্ত এক সমুদ্রে বাস ইলিশের চেহারায় এত তফাৎ কেন? কাঁথির ভারপ্রাপ্ত মৎস আধিকারিক(সামুদ্রিক) সুরজিৎ বাগের কথায়, ‘ডায়মন্ড হারবার অসংখ্য খাড়ি বেয়ে সমুদ্রে নামছে। খাড়ির মুখে ছোটদের ভিড় বেশি তাই ওই সাইজের ইলিশ পাচ্ছেন আর দিঘার মৎসজীবীদের সামনেই সমুদ্র, খাড়ির কোনও বালাই নেই। এই গভীরতায় বড় সাইজের ইলিশের প্রাধান্য বেশি।’
আশার কথাও শুনিয়েছেন এই আধিকারিক। বলেছেন, ‘এখনও অবধি যে খবর পাচ্ছি তাতে ভাল ইলিশই আসছে দিঘায়। এবার ইলিশের পরিমানে ও পরিমাপে ভাল ইলিশ পাওয়া যাবে এমনটাই মনে করছি। অন্য যে সব মাছ মিলেছে সেই পমফ্রেট বা চিংড়ি আকারে এবং প্রকারে বেড়েছে, ইলিশেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার নয়।’
কিন্তু গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতই ফের বঙ্গোপসাগরে যে নিম্নচাপ ঘনীভূত হয়েছে তার জেরে দক্ষিণবঙ্গ ও উপকূলবর্তী এলাকায় আগামী দুদিনের মধ্যে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দফতর । এই সঙ্গে মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে ।
কাকদ্বীপ মৎস্যজীবী সংগঠনের নেতা বিজন মাইতি ও দিঘার মৎস্যজীবীদের সংগঠনের পক্ষে শ্যামসুন্দর দাস জানিয়েছেন যে খাবার আবহাওয়ার কারণে যে সব ট্রলার সমুদ্রে গিয়েছে সেগুলোকে ফিরে আসার জন্য বলা হয়েছে । এই সময়ে সমুদ্র থেকে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছ ধরা পড়বে । কিন্তু মৎস্যজীবীদের সরকারি নির্দেশ মেনে এখন সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে ।
আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে যে এখন অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তর ও ওডিশার দক্ষিণ উপকূলবর্তী এলাকায় ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়ে তা গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে । তার ফলে আগামী দুদিনের মধ্যে বর্ষণের তীব্রতা বাড়বে । সোমবার সারাদিন বৃষ্টি হবে ও মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ও তার সঙ্গে জুড়তে চলা ঘূর্ণাবর্তের শক্তির ফলে বৃষ্টি বাড়বে। সমুদ্র উত্তাল হবে তাই গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে । তাহলে কী ফের কিছুদিনের বিরতি বাঙালির পাতে?
মৎস আধিকারিক বাগের কথায়, নিম্নচাপ ঘনীভূত হওয়ার খবর মিলেছে বটে তবে তা দক্ষিনপূর্বে ওড়িশার জলসীমা ঘেঁষে। আমাদের মৎসজীবীরা সোজা দক্ষিনে নামেন তাই খুব বেশি সমস্যার কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে।৪৮ ঘন্টার জন্য একটা সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে সেই মত। যদি কেউ দক্ষিনপূর্বে চলে যান ফিরে আসুন দক্ষিনে। অবশ্য আমাদের মৎসজীবীরা খুবই অভিজ্ঞ জলের মোচড় (স্ক্রল) বেশি হলে বুঝতে পারেন নিজেরাই। সরে যান নিরাপদ জায়গায় ফলে খুব চিন্তার কিছু নেই।”
দিঘার মোহনা বাজারে পাল্লা খাটিয়ে বসে আছেন আড়াই দশকের অভিজ্ঞ আড়তদার নবকুমার পয়ড়্যা। সমুদ্রে না গিয়েও বাজারে বসেই নাড়ি টিপে বলে দেন সমুদ্রের হাঁড়ির খবর। ইলিশ নাকি জালে পড়ার আগেই জানিয়ে দেয় কোন ট্রলারে উঠছে তার নাম ঠিকানা। হাসতে হাসতে বললেন, ঘোড়ার মুখের খবর তারা আসছে। আগাম বলে দিচ্ছি এবার যা ইলিশ আসবে তা কয়েক বছর ধরে দেখেনি দিঘা। খালি সময়ের অপেক্ষা। হাজার দেড়েক ট্রলার নামার কথা। নেমেছে মাত্র শ’খানেক! কম সৈন্য নিয়ে তুমি ইলিশ জয় করবে, ইলিশ কী এতই ফেলনা?।”
রসিকতা। ছেড়ে নবকুমার বাবু বলেন, ‘এখনও পর্যন্ত যে নমুনা দিঘার মোহনা বাজারে পেশ হয়েছে এবং সমুদ্র শিকারে যাওয়া মৎসজীবীদের সঙ্গে যে টুকু কথা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে ভাল ইলিশের মুখ দেখবে দিঘা। এটা লকডাউন এফেক্ট বলতে পারেন। সমুদ্র নির্মল ও খাদ্যযুক্ত হয়েছে। দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা থাকায় ছোট ইলিশ ভুল করেও ধরা পড়েনি এবার। তবে আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে কারন আরও বেশ কিছু ট্রলার এখনও নামার অপেক্ষায়।