পলাশ খাঁ , গোয়ালতোড় :- দুশো লিটার দুধের ক্ষীরশার ভোগ দেওয়া হয় গোয়ালতোড়ের এরিয়ামারা গ্রামের ঘোষ পরিবারের কমলা রুপী লক্ষীকে। এরিয়ামারা গ্রামের ঘোষ পরিবার ছিল জমিদারের নায়েব৷ সেই নায়েবের কাজ কবেই চলে গেছে , কিন্তু নায়েব বাড়ির ধনদেবীর আরাধনাতে নায়েবিয়ানা এখনো বজায় আছে। আছে পূর্ব পুরুষদের নিয়ম অনুযায়ী মায়ের পূজা করা । কারন ঘোষ পরিবারের স্বর্গীয় গোকুলানন্দ ঘোষ নিজেই ছিলেন মা সিংহবাহিনীর পরম ভক্ত । আদিবাড়ি বর্ধমানের রায়নাতে তৈরী করেছিলেন সিংহ বাহিনী মা দুর্গার মন্দির । তারপর নিয়তির পরিহাসে গোকুলানন্দের স্ত্রী বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এসে পৌঁছান গোয়ালতোড়ের এরিয়ামারাতে । সেখানেই পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন । তারও বহুদিন পর এড়িয়ামারার ঘোষ বাড়িতে শুরু হয় ধনদেবীর আরাধনা ।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোয়ালতোড়ের এরিয়ামারা গ্রামের ঘোষ পরিবারের ধনদেবী কমলা রুপে পুজিতা হন। এই বছর ঘোষ পরিবারের পূজো ১৩০ বছরে পা দিল । ঘোষ পরিবারের লক্ষী পুজো সূচনার পেছনে রয়েছে অলৌকিক ঘটনা । গোকুলানন্দ ঘোষের স্ত্রী রতনমনি দেবীর উত্তরসূরী গোপাল ঘোষের পুত্র বনমালী ঘোষ বংশানুক্রমে প্রায় আট দশটি মৌজার জমির মালিক ছিলেন৷ বিভিন্ন মৌজাতে প্রতিদিন অসংখ্য কৃষিশ্রমিক জমিতে কৃষি কাজ করতেন। ঘোষ পরিবারের সুত্রে জানা যায় আজ থেকে একশত তিরিশ বছর আগে কৃষি কাজের সময় এরিয়ারামারা মৌজার জমিতে লাঙ্গল করছিলেন কৃষি শ্রমিকেরা। সেই সময় লাঙ্গলের ফলাতে কোনো ধাতব বস্তুর আওয়াজ শুনতে পান তারা। কৌতুহলী হয়ে সেই খানের মাটি সরিয়ে দেখেন একটি ধাতব মা লক্ষীর মুর্তি। কমেলেকামিনী রুপ, যা মা লক্ষীর আরেক রুপ৷ ।
সেই মুর্তি বাড়ি নিয়ে আসেন বনমালী ঘোষ। বাড়ির তুলসী তলায় রেখে দেন সেই রাত্রেই মা কমেলেকামিনীর স্বপ্নাদেশ পান তিনি। মন্দির নির্মাণ করে কমলা রুপে তার পুজো করার নির্দেশ দেন। মায়ের সেই নির্দেশ পেয়েই শুরু করেন মন্দির নির্মাণের কাজ। সুরম্য কংক্রিটের মন্দির নির্মাণ করে সেখানেই মা কমলার সেই প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেন বারোশ ছিয়ানব্বই সালের এক কোজাগরী লক্ষী পুজোর দিন। সেই থেকে আজও ঘোষ পরিবারে বংশপরম্পরায় সেই পুজো হয়ে আসছে।
পুজো উপলক্ষে বনমালী ঘোষের সমস্ত মৌজার প্রজাদের ও অন্যান্য পাশাপাশি বন্ধু বান্ধবদের দুপুরে খাওয়ানো হতো । বসত যাত্রার আসর। ভাড়া করে আনা হতো আর্মেনিয়ান ঝাড়বাতি। পুজোর দিন ঘট ডুবানোর জন্য ১কি.মি দূরের বাঁধে বাজনা , বাদ্য , শাঁখ ও উলুধ্বনি সহকারে নিয়ে যাওয়া হয় ঘট ডুবাতে যাওয়া হয়। পুজোর তিন দিনই ২০০ লিটার দুধের ক্ষীরশা করে মায়ের প্রসাদ দেওয়ার রীতি এখনো রয়েছে। পুজো উপলক্ষে তিন দিন ধরে চলে মেলা, আয়োজন করা হয় যাত্রার।
এই বছরও মায়ের পূজোর আয়োজনের বিন্দুমাত্র খামতি নেই । তবে করোনার কারনে এবার দুরদুরান্তের আত্মীয়স্বজন আসতে পারছেন না, তিন দিন গ্রাম জুড়ে যে মায়ের অন্নভোগ প্রসাদ খাওয়ানো প্রথা ছিল সেটাও বন্ধ থাকবে এবার৷ বন্ধ থাকবে সমস্ত রকমের অনুষ্ঠান। পুজোর সঙ্গে জড়িত ব্যাক্তিরাই কেবল মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন৷ তবে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার বাধ্যতামূলক। ঘোষ পরিবারের এক সদস্য তপন কুমার ঘোষ বলেন , ” কর্তারা যে ভাবে নিষ্ঠা সহকারে পূজো করে আসছেন , আমরা এখনো কর্তাদের নির্দেশ পালন করে আসছি । পূজোর আয়োজনের বিঘ্ন যাতে না ঘটে সেদিকে সদা সতর্ক থাকতে হয় ।”
পরিবারের বিভিন্ন সদস্যরা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আছে । পূজো তে সকলেই একসঙ্গে মিলিত হয় অন্যান্য বছর। এবার করোনার জেরে আত্মীয়স্বজনেরা আসছেন না৷ খরচও কাউকে বলতে হয়না । নিজেরাই দেয় । তাই আয়োজনের খামতি হয় না। তবে এরিয়ামারার ঘোষ পরিবারের এই লক্ষী পূজা যেমন ঘোষ বাড়ির পুর্নমিলন তেমন আনন্দ উপভোগ করেন এরিয়ামারা সহ পাশাপাশি বহু গ্রামের মানুষজন ।