ভবানী গিরি: মাত্র ৩৬ ঘন্টা! তারই মধ্যে ফের হাতির হামলায় মৃত্যু হল আরও একজনের আর এবার সেই মর্মান্তিক পরিনতির শিকার একজন বনকর্মী। প্রায় একই এলাকায় পরপর দুজনের মৃত্যু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে বনদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে। তার ওপর খোদ বনকর্মীর মৃত্যুতে প্রশ্ন উঠেছে যে, যাঁরা সারা বছর হাতি নিয়েই কাজ করে থাকেন তাঁরাই যদি হাতির হামলার শিকার হন তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী? ঘটনাকে কেন্দ্র বনবিভাগের সমালোচনায় কোথাও ক্ষোভ কোথাও আবার বিদ্রুপ উপচে পড়তে দেখা গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
বনদপ্তর সূত্রে জানা গেছে সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ হাতির দ্বিতীয় হামলাটি ঘটেছে ঝাড়গ্রাম ব্লকের আমলাচটি ভেষজ উদ্যানে। এদিন সকালে ৪টা হাতি ওই ভেষজ উদ্যানের বাগানে ঢুকে পড়েছিল কোনওভাবে। বাগানটি চতুর্দিকে ঘেরা থাকায় সন্ধ্যা পর্যন্ত বেরোতে পারেনি হাতির দলটি। এদিকে দক্ষিনবঙ্গের মূল্যবান এই ভেষজ বাগানের ক্ষয়ক্ষতি আটকানোর লক্ষ্যে খবর পাওয়ার পরই বনকর্মীরা চেষ্টা করছিলেন হাতিগুলিকে বের করার। এই সময়ই একটি হাতি হামলা চালায় ঝাড়গ্রাম বনবিভাগের রক্ষী বুদ্ধদেব শবরের ওপর। তিনি ঝাড়গ্রাম বন বিভাগের অধীন লোধাশুলি রেঞ্জের ৪২ বছরের বুদ্ধদেব শবর গুরুতর আহত হন। পরে ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর।
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে এক প্রত্যক্ষদর্শী বনকর্মী জানিয়েছেন, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। যে দিকের ফেনসিং ভেঙে হাতিগুলি ঢুকেছিল প্রথমে সেই পথে হাতিগুলিকে বের করার চেষ্টা হয়। বারবার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ঠিক হয় বাগানের মূল ফটক খুলে ওই দিক দিয়েই বের করে দেওয়া হবে হাতির দলটিকে কারন যদি রাতে হাতি বাগানে থেকে যায় তবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভবনা। এই গেট খুলতে গিয়েই বিপত্তি হয়। চারটি হাতির দলের মধ্যে দাঁতালটি যে আলাদা হয়ে গেছে এবং সেটা যে ওই গেটের পাশেই একটি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল তা বোঝা যায়নি ঝোপঝাড় এবং সন্ধ্যার জন্য।হয়ত দলের সর্দার হিসাবে সেও এসেছিল গেট ভেঙে নিজেদের বেরুনোর পথ করে নিতে। বুদ্ধদেব গেটের সামনে যাওয়া মাত্রই দাঁতালটি আচমকা তাঁকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে আছাড় মারে।” রক্তাক্ত অবস্থায় দূরে ছিটকে পড়েন। বনকর্মীরা দ্রুততার সঙ্গে তাঁকে উদ্ধার করে ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রাথমিক ভাবে দেখা গিয়েছিল তাঁর ডান পা গুঁড়িয়ে গেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে সিসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই রাত্রি দশটা নাগাদ মারা যান বুদ্ধেদেব।
রবিবার এই উদ্যান থেকেই কিছুটা দুরে শালবনী গ্রামপঞ্চায়েতের বরিয়া গ্রামের বাসিন্দা পাড়ু মাহাতর মৃত্যু হয়েছিল হাতির হামলায়। ওইদিন ভোর বেলায় কুড়চি ফল কুড়োতে গিয়ে হাতির কবলে পড়েছিলেন তিনি। ঘটনার পরই উত্তেজিত গ্রামবাসীরা লোধাশুলি হয়ে ঝাড়গ্রাম ঢুকের পাঁচ নম্বর রাজ্য সড়ক অবরোধ করে । প্রায় দেড় ঘন্টা পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে অবরোধ উঠেছিল। ওই ঘটনার মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যেই বরিয়া গ্রামে গিয়ে মৃতের পরিবারের হাতে ৫ লক্ষ টাকার চেক তুলে দিয়ে মানুষের ক্ষোভে কিছুটা হলেও প্রলেপ দিয়েছিল বনদপ্তর কিন্ত এবার সেই হাতির হামলার শিকার হলেন খোদ বনকর্মীই।
এই দুই ঘটনার কিছুদিন আগেই হাতির হামলায় প্রাণ গিয়েছিল জামবনির আমলিয়া বিটে হাতির হানায় মৃত্যু হয় রুটু বাগালের। ঝাড়গ্রাম বন বিভাগের অধীন জঙ্গল এলাকায় দলমার দলের হামলায় সারা বছর ধরেই প্রাণহানি, শস্যহানি আর সম্পত্তিহানি ঘটেই চলে। তারই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছিল রবিবার পথ অবরোধে। তারপরই কয়েকটি গ্রামের মানুষদের নিয়ে বৈঠক করেন ঝাড়গ্রাম ডিএফও শেখ ফরিদ। আশ্বাস দেন হাতি তাড়ানোয় নির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করা হবে। তারপরই ঘটে গেল আরেকটি ঘটনা।
এদিকে ঝাড়গ্রাম কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুর, সমগ্র জঙ্গলমহল জুড়েই অব্যাহত হাতির হামলা। এদিনই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় শালবনী ব্লকের বিষ্ণুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভাউদি এলাকায় হাতির হানায় তিনটি বাড়ি ভেঙেছে বলে স্থানীয়রা জানান। বাসিন্দারা জানিয়েছেন সন্ধ্যা বেলা একটি হাতি জঙ্গল ছেড়ে ওই এলাকায় ঢুকে পড়ে খাবারের খোঁজে। শান্তনু বিষই নামে এক ব্যক্তির ধানকলের ঘর ভেঙে ধান, চাল, গম খেয়ে ফেলে। ধান, গম ভাঙাতে দেওয়া মানুষজনেরও মাথায় হাত। লকডাউনে এমনিতেই মানুষের হাঁড়ির হাল সঙ্কটজনক হয়ে পড়েছে সাবার করে দিয়েছে হাতি। জানা গেছে এলাকার যাদব মাহাতো সহ আরও একজনের বাড়ি ভেঙে চাল খেয়ে ফেলে। বনবিভাগের তরফে জানানো হয়েছে হাতিটিকে অন্যত্র সরানোর পাশাপাশি সরকারী নিয়মানুসারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।