Homeঅন্যান্যফিরে দেখা ২০২০।। শুধু যাওয়া আসা

ফিরে দেখা ২০২০।। শুধু যাওয়া আসা

২০২০- ফিরে দেখা, এক অশান্ত বছর

অশ্লেষা চৌধুরী: বিষে নাকি বিষক্ষয়-কিন্তু ২০২০ এই বিশ যেন বেশি করে বিষ উগরে দিয়েছে। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একের পর এক দুঃসংবাদে আমরা জর্জরিত হয়েছি।

শুরুটা হয়েছিল জানুয়ারির শেষ থেকে, ছোট্ট এক ভাইরাসের হানা একেবারে অতিষ্ট করে তোলে আমাদের জীবন। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্ববাসীকে রীতিমত ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে সে। জন্মানোর কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ব মহামারীর তকমা অর্জন করে নিয়েছে সে। প্রাণ কেড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের, আমাদের জীবনযাত্রায় এনে দিয়েছে আমূল পরিবর্তন। ভাইরাসের তাণ্ডবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ২২ শে মার্চ জনতা কার্ফিউ-এর ঘোষণা করা হয়। স্তব্ধ হয়ে যায় জনজীবন। এরপর ২৪ শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সমগ্র দেশব্যাপী ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেন। ২৫ শে মার্চ থেকে চারটি পর্যায়ে ৩১ শে মে ২০২০ অব্দি চলে লকডাউন। এরপর শুরু হয় আনলক পর্বে মিলতে শুরু হয় ছাড়। স্বাভাবিক জনজীবনের জন্য ১ জুন থেকে ৩১ শে ডিসেম্বর অব্দি সাত পর্যায়ে আনলক পর্ব ঘোষিত হয়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না। কিন্তু এই লকডাউন ও আনলক পর্বে আমরা অনেক রকম ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছি। লকাডাউনে কাজ হারা হয়ে মৃত্যু বরণ করতে দেখেছি সাধারণ মানুষদের, দেখেছি পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা। কাজ হারা হয়ে, অর্থের অভাবে রাস্তায় রাস্তায় তাঁদের আটকে থাকতে দেখেছি। পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে দেখেছি তাঁদের। এমনকি সেই সময় ক্ষিদে ক্লান্তিতে অসহায় অবস্থায় ঘুম্মিয়ে পড়া মানুষগুলোকে ট্রেনে কাটা পড়ে, কখনও বা বাস ও লরির চাকায় পিষে মরতেও দেখেছি।

এরপর ১৫ই জুন ২০২০, মধ্য রাতে ঘটে যায় মারাত্মক এক দুর্ঘটনা। অবশ্য দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে, সেটা ছিল হিংসা ও কুটিলতার নিদর্শন। চীনে ড্রাগন বাহিনীর অতর্কিত আক্রমনে আমাদের দেশের ২০ জন বীর সন্তান শহীদ হন। রাগে, ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে দেশবাসীরা। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে চীনের বিরুদ্ধে করা করা ডিজিটাল স্ট্রাইক। বর্জন করা হয় চীনা পণ্য।

এই বছরেই মে মাসে মাঝামাঝি আমরা দেখেছি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, যার সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৮৫ কিমি। আর কলকাতায় ঝড়ের সর্বোচ্চ বেগ ঘণ্টায় ১৩৩ কিমি। আমফানের তাণ্ডবলীলায় কার্যত ধ্বংস স্তুপের চেহারা নেয় বাংলার একাংশ। কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ পরিষেবা ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

পাশাপাশি এই বছরে রাজনীতির আঙিনাতেও ব্যাপক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নতুন বছরেই বিধানসভা নির্বাচন, আর সেই নির্বাচন ঘিরে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায় বাংলায়। হিংসার খেলার মেতে ওঠে শাসকদল ও বিরোধী দলগুলো। প্রাণ হারায় অনেক নেতা কর্মী। বছরে সেরা চমকটা দেন শুভেন্দু অধিকারী; অনেক দিন থেকে চলে জল্পনা সত্যি করে ১৯ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের হাত ধরে তিনি যোগ দেন পদ্ম শিবিরে। সেই সাথে আরও ৯ বিধায়ক সহ বিভিন্ন শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরাও একই পথে হাঁটা দেন। তবে তার থেকেও বড় চমক দেন বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁর স্ত্রী সুজাতা। সকলকে চমকে শুভেন্দুর পদ্ম শিবিরে যোগ দেওয়ার দুদিনের মধ্যেই তিনি শাসকদলের পতাকা হাতে তুলে নেন। তার পুরষ্কার হিসেবে অবশ্য স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স নোটিশটাও তিনি পেয়ে যান।

এতসবকিছুর সাথে সাথে চমক দিতে ছাড়েনি মহাকাশ জগৎও- গোলাপি চাঁদ, বড়মাপের গ্রহাণুর পৃথিবীর পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া, পূর্ণ বলয় গ্রাস সূর্যগ্রহণ। এদিন সূর্যকে ঢেকে দেয় চাঁদ, তৈরি হয় আগুনের আংটি বা রিং অফ ফায়ার।

২০২০ আঁচ থেকে রক্ষা পায়নি বিনোদন জগতও। জনপ্রিয় অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত মাত্র ৩৪ বছর বয়সে নিজের ঘরেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মঘাতী হন। যদিও সেটাকে আত্মহত্যা বলে মানতে নারাজ সুশান্তের পরিবার ও তার ভক্তকুল। শুরু হয় তার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, সেই অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে তাঁকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে তাঁদের লড়াই, সিবিআই তদন্তের দাবী ওঠে, যদিও এখনও সুশান্ত মৃত্যুর সুরাহা হয়নি।

এরই সাথে সাথে আমরা হারিয়েছি ইরফান খান, ঋষি কাপুর, বাংলা চলচ্চিত্র জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সহ আরও অনেকেই। শূন্য হয়েছে রাজনীতির আঙিনা, শিল্পী জগৎ, সাহিত্য জগৎ, খেলার দুনিয়া সবটাই। সেই সকল ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং ফিরে দেখা-

রূপালি পর্দা যাঁদের কারণে উজ্জ্বলতা হারিয়েছে– তাপস পাল; একদিকে নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সকলের নজর কাড়েন, অপরদিকে বিধায়ক, সাংসদ নির্বাচিত হয়ে একাধিক বিতর্কে জড়ান। চিটফান্ড-কাণ্ডে কারাবাসও করতে হয় রুপোলি পর্দার নায়ককে। ২২ ফেব্রুয়ারি, মাত্র ৬১ বছর বয়সে সমস্ত জনপ্রিয়তা, বিতর্ককে অবজ্ঞা করেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।

সন্তু মুখোপাধ্যায়; ১১ মার্চ, ৬৯ বছরে সুযোগ্য কন্যা অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়কে রেখে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন।                             ইরফান খান; এপ্রিলের ২৯ তারিখ, রিল এবং রিয়েল লাইফ থেকে আচমকাই ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যান বলিষ্ঠ চেহারার মানুষটি।                                   এর ঠিক পরের দিনই ফের খসে পড়ে আরও এক নক্ষত্র- ঋষি কাপুর; এপ্রিলের ৩০ তারিখ ৬৭ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ঋষি। শরীরে বাসা বেঁধেছিল মারণ কর্কটরোগ। প্রতিটি ছবিতে পরিণত থেকে আরও পরিণত অভিনয়ের ছাপ ফেলে গিয়েছেন তিনি।

ওয়াজিদ খান; জুনের ১ তারিখ ওয়াজিদ খানের মৃত্যুতে ভেঙে গেল সাজিদ-ওয়াজিদ জুটি।    এরপর জুন মাসের ১৪ তারিখ বান্দ্রায় নিজের ফ্ল্যাটে উদ্ধার হল বলিউডের উদীয়মান প্রতিভা সুশান্ত সিং রাজপুতের দেহ। একটি বিতর্কে ঘেরা মৃত্যু, যার মৃত্যুরহস্যের জট খুলল না এখনও।
সরোজ খান; বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ৭১ বছর বয়সে জুলাইয়ের ৩ তারিখ প্রয়াত হন নাচের রানি। নায়ক-নায়িকাদের ‘মাস্টারজি’।

চ্যাডউইক বোসম্য়ান; ২৮ আগস্ট মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই কোলন ক্যানসারের সাথে যুদ্ধে হার মেনে পরলোক গমন করেন তিনি।  এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম; ৭৪ বছরের সংগীতকার মারণ ভাইরাস করোনায় কাবু হয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন।                                                  আসিফ বাসরা; ১২ নভেম্বর, ধর্মশালার এক অ্যাপার্টমেন্ট থেকে উদ্ধার হয় আসিফের ঝুলন্ত দেহ। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে এক প্রতিশ্রুতিমান অভিনেতাকে হারাল বলিউড।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়; ১৫ নভেম্বর, ২০২০ রবিবার, ছুটির দিনে আজীবনের জন্য ছুটি নিয়ে নিলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র।দেবিদাস ভট্টাচার্য ও সুনিল কোঠারি; ২৭ ডিসেম্বর একই দিনে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান। একজন টলিপাড়ার পরিচালক ও অপরজন নৃত্য ইতিহাসবিদ। দুজনের মৃত্যুতেই প্রত্যক্ষ ও পরক্ষ ভাবে করোনার ভূমিকা রয়েছে।

রাজনীতির জগৎ শূন্য করেছেন যাঁরা-
যশবন্ত সিং; বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে গত ২৫ জুন, ৮২ বছর বয়সে প্রয়াত হন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত এই সৈনিক মন্ত্রিসভার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব ছিলেন প্রাক্তন সেনা আধিকারিক। অর্থ, বিদেশ, প্রতিরক্ষা – যখন যে দায়িত্ব পেয়েছেন, দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন তিনি।

সোমেন মিত্র; জুলাইয়ের ৩০ তারিখ ৭৯ বছরের নেতার নিথর দেহ নিয়ে শোকযাত্রায় স্লোগান উঠেছিল – ছোড়দা অমর রহে। আমহার্স্ট স্ট্রিটের মিত্র বাড়ীর ছোট ছেলে খোকন রাজনীতির প্রেমে পড়েই পা রাখেন বাড়ির বাইরে। হয়ে ওঠেন সকলের ‘ছোড়দা’। সবরকম অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ‘ছোড়দা’ ২০১৮ সালে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হন।

প্রণব মুখোপাধ্যায়; অগাস্টের ৩১ তারিখ ৮৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন ভারতীয় রাজনীতির ‘চাণক্য’। কংগ্রেসি মতাদর্শের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ, তারপর সাংসদ, মন্ত্রী, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলে দেশের রাষ্ট্রপতি। একে বয়সের ভার, তার ওপর মস্তিষ্কে জমাট বাঁধে রক্ত, করোনা থাবা বসায় শরীরে। মৃত্যুর কাছে হার মানেন অবশেষে তিনি।

‘খেলা’মাঠ শূন্য যাঁদের কারণে চেতন চৌহান; দীর্ঘ সময় ধরে লড়াইয়ের পর ২৬ জানুয়ারি, দেশের প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে ৭৩ বছর বয়সি ক্রিকেটার জীবনের মায়া কাটিয়ে আউট হয়ে চিরতরে। পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়; বাঙালির প্রিয় পিকে’র জীবনদীপ নিভে গেল ৩০ মার্চ, ৮৪ বছর বয়সে।  চুনী গোস্বামী; ৩০ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনের ময়দান ছেড়ে চলে গেলেন ৮২ বছরের চুনী গোস্বামী। দিয়েগো মারাদোনা; নভেম্বরের ২৫ তারিখ আচমকাই জীবনের খেলার ময়দান ছেড়ে চলে গেলেন ফুটবলের রাজপুত্র।

করোনা কেড়ে নিয়েছে বাংলার ২আন্তর্জাতিক সমুদ্র বিজ্ঞানী অমরেশ চৌধুরী এবং আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়কে। অধ্যাপক চৌধুরী শুধু বিজ্ঞানী নন, ছিলেন খ্যাতনামা শিক্ষক। দেশে বিদেশে অসংখ্য কৃতি ছাত্রছাত্রী রেখে গেলেন তিনি। অন্যদিকে অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞান চর্চা, গবেষনার পাশাপাশি ছিলেন শিক্ষাবিদ। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, দিঘা উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগর জন্মদ্বিশতবার্ষিকী কমিটির সভাপতি সহ নানা দায়িত্ব সামলেছেন দুই মেদিনীপুরের অত্যন্ত প্রিয়জন এই মানুষটি।

এছাড়াও আমরা  হারালাম-
সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য (১৯৩১ – ২০২০)
সাহিত্যিক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত (১৯৩৩ – ২০২০) সাহিত্যিক দেবেশ রায় (১৯৩৬ – ২০২০)
পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায় (১৯২৭ – ২০২০)
অভিনেতা-গায়ক শক্তি ঠাকুর (১৯৪৭ – ২০২০)
সংগীতশিল্পী পণ্ডিত যশরাজ (১৯৩০ – ২০২০)
রাজনীতিবিদ শ্যামল চক্রবর্তী (১৯৪১ – ২০২০)
রাজনীতিবিদ তরুণ গগৈ (১৯৩৪ – ২০২০)
সমাজকর্মী স্বামী অগ্নিবেশ (১৯৪০ – ২০২০)
পরিচালক নিশিকান্ত কামাত (১৯৭০ – ২০২০)
ফ্যাশন ডিজাইনার শর্বরী দত্ত (১৯৫৭ – ২০২০)
ফুটবলার পাওলো রোসি (১৯৫৬ – ২০২০)
ফুটবলার মণিতোম্বি সিং (১৯৮১ – ২০২০)
ক্রিকেটার ডিন জোন্স (১৯৬১ – ২০২০)
ফুটবল কোচ আলেজান্দ্রো সাবেয়া (১৯৫৪ – ২০২০)

সারা বছর জুড়ে নানান ভাবে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে আমাদের হৃদয়। বিশ সালের বিশের জ্বালা একুশে যেন নিরাময় হয়, সেদিকেই তাকিয়ে এখন আমরা সকলে। আমাদের আশা নতুন বছরে পুরোনো সমস্ত আঁধার কেটে গিয়ে রোদ ঝলমলে আকাশ দেখা দেবেই।

RELATED ARTICLES

Most Popular