নিত্য গুপ্ত : “ম্যাডাম আমি আপনাকে সঠিক শ্ৰেণী বিন্যাস ( কারেক্ট ক্ল্যাসিফিকেশন) প্রেরণ করছি।” ৩০এপ্রিল কেন্দ্রের স্বাস্থ্য সচিব প্রীতি সুদনকে একটি চিঠিতে রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি জানাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য সচিব বিবেক কুমার। ওই দিন দুপুর তিনটায় যখন এই চিঠি পাঠানো হচ্ছে তখন তিনি প্রীতি সুদানকে একটি একটি এনক্লোজার জুড়ে দিয়েছেন যেখানে রাজ্যের করোনা আক্রান্তের পরিসংখ্যান। বলা হচ্ছে বাংলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৯৩১। পরের ঘটনা আরও তিন ঘন্টা পরে। নবান্নে প্রতিদিনের মত সাংবাদিকদের করোনা আপডেট দিতে গিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা জানাচ্ছেন, রাজ্যে করোনা আক্রান্ত ৭৪৪। সাংবাদিক সম্মেলন সেরে স্বস্তির সময়টুকু পের হয়নি মুখ্যসচিবের, ফাঁস হয়ে গেল বিবেক কুমারের চিঠি। দেখা গেল নবান্নের অভ্যন্তরেই আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে বিস্তর ফারাক এবং সেই ফারুকের সংখ্যাটা ১৮৭ জনের! আর বিবেকের চিঠিতেই আরও একটা সত্য পরিস্কার হয়ে গেল যে কলকাতা করোনার আড়ত হয়ে বসে আছে। সেদিন পর্যন্ত আক্রান্ত ৪৮৯! বিবেকের সেই চিঠির ধাক্কায় টানা দু’দিন বন্ধ হয়ে গেল নবান্নের করোনা বৈকালিকী। সেই দু’দিন রাজ্যবাসী জানতে পারলনা, রাজ্যের করোনা চিত্র।
মঙ্গলবার, সেই ঘটনার ১২দিনের মাথায় স্বাস্থ্য সচিব থেকে সরিয়ে দেওয়া হল বিবেক কুমারকে,নির্বাসিত করা হল পরিবেশ দপ্তরে। প্রবীন, সংস্কৃতবান,রসিক বিবেক ঢেঁকি হয়ে সেখানেও ধান ভাঙেন কিনা সেটা পরে দেখা যাবে কিন্তু তিনি যে যুগান্তকারী কাজটা করে গেলেন তা’হল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে রাজ্য আর কেন্দ্রের গরমিলটা ঠিক করে দিলেন। ৩০ তারিখ অবধি আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে রাজ্য এক রকম রিপোর্ট দেয় তো কেন্দ্র অন্যরকম। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই কেন্দ্রের রিপোর্ট মেলেনা। কেন্দ্র তখন, ‘ সব বেশি বেশি করে দেখাচ্ছে।’ ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় দল ঢুকে গেছে। করোনা আক্রান্ত সংখ্যা,পরিস্থিতি মোকাবিলা, লকডাউন বলবৎ করা নিয়ে সংঘাত চরমে। রাজ্য প্রশাসনকে কেউ মানছে বলে মনে হচ্ছেনা, খোদ মুখ্যমন্ত্রী গাড়ি আর মাইক নিয়ে মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচে ছুটছেন জনতাকে ঘরে ঢুকে যাওয়ার অনুরোধ করতে। সেই আবহে বিবেকের চিঠি ফাঁস।
২দিন পরে ফের নবান্ন করোনা বুলেটিন প্রকাশ করল তবে ফরম্যাট বদলে আর কী আশ্চর্য্য! অনেকটাই ঠিক ঠাক মিলে যাচ্ছে কেন্দ্র আর রাজ্যের আক্রান্তের সংখ্যা! এখন ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে কো মর্বিডিটির তত্ত্ব। আর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা। প্রশ্ন প্রথম থেকে বিষয়টা, অঙ্কটা প্রকাশ্যে এলে মানুষ এবং সরকার দু’পক্ষই কী আরও সচেতন হতে পারতনা? বিরোধীরা যখন বলে চলেছে তথ্য গোপন করা হচ্ছে।বিবেকের সেই চিঠি তখন সেই দাবিকেই সিলমোহরের ছাপ দিল।
কিন্তু পরের বিষয়টি আরও একটু তলিয়ে ভাবার। বিরোধীরা দাবি করছিলেন করোনার প্রকৃত চিত্র সরকার গোপন করেছে, আসল আক্রান্তের সংখ্যা আড়াল করা হচ্ছে আর কো মর্বিডিটির তত্ত্ব দেখিয়ে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাও লুকোনো হচ্ছে। দু’দিন বাদে সাংবাদিক সম্মেলন করে রাজীব সিনহা জানালেন, আক্রান্তের সংখ্যাটা আসলে বের করাটা একটা জটিল পদ্ধতি, বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সময়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছেনা ফলে একটু সমস্যা হচ্ছিল ঠিকই তবে এখন থেকে আর সমস্যা হবেনা কারন রাজ্য সরকার আক্রান্ত হিসাব করার পদ্ধতিটা এবার বুঝে ফেলেছে। অর্থাৎ মুখ্য সচিব বিরোধীদের দাবিকে যথার্থ বলেই মেনে নিলেন কিন্তু দায়টা চাপালেন হাসপাতাল আর জটিল অঙ্কের ওপর, সাথে সাথে স্বীকার করে নিলেন কেন্দ্র এবং অন্য রাজ্যগুলির আমলা আর কর্মচারীদের মত অঙ্ক রাজ্যের আমলা আর কর্মচারীদের জানা নেই।
কিন্তু ঘটনা কি তাই? যদি তাই হয়ে থাকে তবে প্রশ্ন উঠছে তাহলে কেন্দ্রকে ওই সংখ্যাটা জানতেন কে? যে সংখ্যার জন্য কেন্দ্র বুলেটিনে রাজ্যের চেয়ে বড় অঙ্ক এবং এখন মনে হচ্ছে সঠিক অঙ্কই দেখানো হত! আর স্বয়ং স্বাস্থ্য সচিব মুখ্য সচিবের থেকে এগিয়ে ১৮৭ জন এগিয়ে থাকলেন কি করে? স্বাস্থ্য সচিবের কাছ থেকেই তো মুখ্য সচিবের কাছে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য যাওয়ার কথা তাইনা?
সব শেষে আরও একবার প্রীতি সুদনকে পাঠানো রাজীব কুমারের বয়ানটা মনে করার চেষ্টা করা যাক, “ম্যাডাম আমি আপনাকে সঠিক শ্ৰেণী বিন্যাস ( কারেক্ট ক্ল্যাসিফিকেশন) প্রেরণ করছি।” তার মানেটা কী দাঁড়ায়? রাজ্যের পাঠানো তথ্য গুলি কি সঠিক ছিলনা! বিবেকের নির্বাসন কি সেই কারনে?